Inqilab Logo

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গল্প : দুই বন্ধু

| প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো হা ম্ম দ   আ ব্দু ল্লা   হে ল   বা কী : স্বপ্নীলের দাদুভাই স্কুল শিক্ষক। খুব রুচিবোধসম্পন্ন। নীতিজ্ঞ। গ্রামের লোকেরা তাঁকে খুব মান্য করে। যে কোন কাজে তাঁকে ডাকে। তাঁর উপস্থিতিতে যে কোন অনুষ্ঠান অলঙ্কৃত হয়। তাঁর চেহারা যেমন তা¤্রঘষা, কথাবার্তাও তেমন পরিচ্ছন্ন। তাঁর ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে। মানুষ বশীভূত হয়।  তিনি অনেক আগে ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন। ইচ্ছে করলে অনেক বড় কিছু হতে পারতেন। স্কুল শিক্ষক হয়ে গ্রামের মানুষের পাশে রয়ে গেলেন। তিনি গ্রামের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ¦ালিয়েছেন। তাঁর কারণেই শিমুলডাঙ্গা আজ আদর্শ গ্রাম। বিভিন্ন কাজে তিনি গ্রামের মানুষকে পরামর্শ দেন। তিনি এখনো অনেক পড়াশোনা করেন। এবং মানুষকে পড়তে বলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্ জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। যত পড়বে, তত মনের অন্ধকার দূর হবে। আমরা যদি প্রতিদিন একটি করেও বই পড়ি, আমাদের জীবদ্দশায় খুব সামান্যই জানতে পারব। জ্ঞান সমুদ্র অতি বিশাল। এর রয়েছে বিচিত্র শাখা-প্রশাখা। বিজ্ঞান বলে, বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে এ বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টি হয়েছে। সেদিন থেকে সময়ের শুরু। সেদিন থেকে জ্ঞানেরও শুরু। তাহলে বিগ ব্যাং এর আগের একটি অংশ মানুষের আড়ালে রয়ে গেছে। মানুষ চেষ্টা করলেও তা জানতে পারবে না। আমাদের উচিত জ্ঞানার্জনে মেতে থাকা এবং তা অন্যের সাথে শেয়ার করা। তাহলে আমরা পরচর্চা, পরনিন্দা এককথায় গিবত থেকে দূরে থাকতে পারব। গিবত ভয়াবহ অন্যায়। গিবত সমাজ বিধ্বংসী।’
এক সপ্তাহ আগে থেকে তাঁর মাঝে খুশি খুশি ভাব। তাঁর বন্ধু আসছেন। তাঁর বন্ধু হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির টিচার। নাম দীন ইসলাম। এই নাম স্বপ্নীল অনেক শুনেছে। তার দাদুভাই উনার কথা মাঝে মাঝেই বলেন। উনি রাখাল ছেলে থেকে আজ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। তুখোড় ছাত্র ছিলেন। হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। স্বপ্নীলের দাদুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বপ্নীল জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা দাদুভাই, তোমার কি একটাই বন্ধু? আর কারো নামতো কখনো বলো না। শুধু উনার কথাই বলো।’ এ কথা শুনে তার দাদুভাই হেসে বললেন, ‘আমাদের তোমাদের মতো হাজার হাজার বন্ধু নেই। আমাদের সময় ফেইসবুক, মোবাইল ফোন কিচ্ছু ছিল না। আমাদের বন্ধু কম। বন্ধুত্ব বেশি। জীবনে যদি একটি ভালো বন্ধু পাও, নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে।  দীন ইসলাম আমার ভালো বন্ধু। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকে। কত বড় মানুষ! কত শত কাজে ব্যস্ত। তারপরও আমাকে প্রতি মাসে রুটিন বেঁধে চিঠি লেখে। কত বলি ফোনেতো কথা হয়ই! চিঠি লেখার প্রয়োজন নেই। কে শোনে কার কথা। সে বলে কথা শেষ হয়ে যায়। চিঠি রয়ে যায়। তার পাগলামির জন্য আমাকেও চিঠি লিখতে হয়। কোন মাসে যদি চিঠি লিখতে না পারিÑ তাঁর চিঠিতে কত মান অভিমান ঝরে পড়ে! মানুষকে বলে বেড়ায়, আমি নাকি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছি। আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়।’ একথা শুনে স্বপ্নীল তার দাদুভাইকে বলল, ‘তুমি তাঁর জন্য কী করেছিলে যে, সে আজও অপকটে স্বীকার করে?’
‘আমি যেটুকু করেছি, আমার দায়িত্ববোধ থেকেই করেছি। সেদিনের কথা আমার আজও মনে আছে: চৈত্রের মাঝামাঝি। খড়খড়ে দুপুর। গনগনে রোদ। গাছে গাছে কোকিল বসন্তের জানান দিচ্ছে। উদাস করা প্রকৃতি। প্রকৃতির পরিবর্তন মানুষকে স্পর্শ করে। আমাদের মনের অবস্থাও সেদিন সেরকমই ছিল। আমি আর দীন ইসলাম পুকুর পাড়ে গামাইর গাছে দোল খাচ্ছিলাম। একজন দোলনায় বসি, আরেকজন পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। জোরে ধাক্কা দিলে পুকুরের মাঝখানে চলে যাই। খুব মজা করছিলাম। হঠাৎ আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি, দীন ইসলামদের বাড়ি পুড়ে ছারখার হচ্ছে। আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দীন ইসলামদের ছিল খড়ো ঘর। এক নিমিষে পুড়ে শেষ। দীন ইসলামের বই-খাতা সব পুড়ে গেছে। সে খুব কাঁদছিল। তাঁর কান্না দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। সেদিন তাকে বলেছিলাম, আমি পড়ালেখা করলে তুইও করবি। বাড়িতে এসে মাকে সব খুলে বললাম। মাও খুব ব্যথিত হলেন। আমরা তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এসেছে। মাকে বললাম, ‘মা, দীন ইসলাম আমাদের বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করুক।’ মা রাজি হয়ে গেলেন। শুরু হলো আমাদের একসাথে পথচলা। আস্তে আস্তে সে আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেল। পঞ্চম শ্রেণিতে সে প্রথম হলো। আমি দ্বিতীয় হলাম। তারপর একই স্কুলে ভর্তি হলাম। এসএসসিতে সে খুব ভালো রেজাল্ট করল। এইচএসসিতে সে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। রেকর্ডসংখ্যক মার্ক পেয়ে বোর্ডে ফার্স্ট হলো। স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেল। আমাদের মাঝে দূরত্ব বেড়ে গেল। লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হলো। কিন্তু লোকটার মাঝে কোন অহংকার নেই। শরীরে মাটির গন্ধ। তাঁর চিঠিতে আমাদের সোনালি শৈশব-কৈশোর মূর্তমান হয়ে উঠে আসে। যত পড়ি তত আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। একটি আচ্ছন্নতা আমাকে ঘিরে রাখে অনেক দিন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন