Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শহর দিল্লিতে একদিন

ভ্রমণ : মুসলিম ঐতিহ্য ঘেরা

| প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মু হা ম্ম দ  না জ মু ল  ই স লা ম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
এই পথের দু’দিকের দেয়াল দোকানের মতো করে স্টল দিয়ে সাজানো। চট্টা চক ধরে সোজা এলে উত্তর-দক্ষিণ পথ পাওয়া যায়। এই পথটি আসলে দুর্গের পশ্চিমের সামরিক ক্ষেত্র ও পূর্বের রাজপ্রাসাদের সীমানা। এই পথের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দরজাটিই হলো দিল্লি গেট। দিল্লি গেটের বাইরে একটি বড় মুক্তাঙ্গন রয়েছে। এটি এককালে দিওয়ান-ই-আম-এর অঙ্গন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানে ঝরোখা নামে একটি অলঙ্কৃত সিংহাসনে বসে সম্রাট জনসাধারণকে দর্শন দিতেন। এই স্তম্ভগুলো সোনায় চিত্রিত ছিল এবং সোনা ও রুপার রেলিং দিয়ে সাধারণকে সিংহাসনের থেকে পৃথক করে রাখা হতো। আর দিওয়ান-ই-খাস ছিল পুরোপুরি শ্বেতপাথরে মোড়া একটি কক্ষ। এর স্তম্ভগুলো পুষ্পচিত্রে সজ্জিত ছিল। ভেতরের অলঙ্করণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল মহামূল্যবান ধাতুগুলো।
সিংহাসনের পেছনের দিকে ছিল স¤্রাট পরিবারের নিজস্ব কক্ষগুলো। প্রাসাদ প্রাঙ্গণটিকে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মনে করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ দেখলাম। পড়লাম। জানলাম। আর মুসলিম ঐতিহ্যে চক্ষু শীতল করলাম।
এর পর আমরা এগোলাম কুতুব মিনারের দিকে। কুতুব মিনার হলো ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত একটি স্তম্ভ বা মিনার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার। এটি কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত, প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স এবং মিনারটি তৈরি করা হয়েছে।
লাল বেলেপাথরে নির্মিত এই মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। মিনারটির পাদদেশের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার (৪৭ ফুট) এবং শীর্ষ অংশের ব্যাস ২.৭৫ মিটার (৯ ফুট)। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। মিনার প্রাঙ্গণে আলাই দরজা (১৩১১), আলাই মিনার (এটি অসমাপ্ত মিনারের স্তূপ, এটা নির্মাণের কথা থাকলেও, নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়নি), কুওয়ত-উল-ইসলাম মসজিদ (ভারতের প্রাচীনতম মসজিদসমূহের অন্যতম, যেসব বর্তমানে আছে), ইলতুতমিসের সমাধি এবং একটি লৌহস্তম্ভ আছে।
একাধিক হিন্দু এবং জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই মিনার নির্মিত হয় বলে কথিত আছে। অনুমান করা হয় যে ভারতে ইসলাম শাসনের প্রথম দিকে বহিরাগত আক্রমণে এই মন্দিরসমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
প্রাঙ্গণ কেন্দ্রস্থল ৭.০২ মিটার (২৩ ফুট) উচ্চতাবিশিষ্ট যেখানে চকচকীয়া লৌহস্তম্ভ আছে, যা আজ পর্যন্ত একটুও মরিচা ধরেনি। এই লৌহস্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের একটা লেখা আছে। ১১৯২ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক এই মিনারের নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেছিলেন। ইলতুতমিসের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের কাজ শেষ হয়।
আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) এটার প্রাঙ্গণ এবং নির্মাণ নির্মাণকাজ সম্পাদন হয়। পরবর্তীকালে বজ্রপাতে মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদিও তার সংস্কার করা হয়েছিল।
এর আশেপাশে আরও বেশ কিছু প্রচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যারা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। ইসলামিক স্থাপত্য এবং শিল্পকৌশলের এক অনবদ্য প্রতিফলন হিসেবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার (রা) বিভাগে এই প্রাঙ্গণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করে।
এটি দিল্লির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এটি ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ পরিদর্শিত সৌধ এবং পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩৮.৯৫ লাখ যা তাজমহলের চেয়েও বেশি, যেখানে তাজমহলের পর্যটন সংখ্যা ছিল ২৫.৪ লাখ।
আফগানিস্তানের জাম মিনার এর অনুকরণে এটি নির্মিত হয়। পাঁচতলাবিশিষ্ট মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি বা ঝুলন্ত বারান্দা। কুতুব মিনারের নামকরণের পেছনে দুটি অভিমত রয়েছে, প্রথমত এর নির্মাতা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নামানুসারে এর নামকরণ। দ্বিতীয়ত ট্রান্সঅক্সিয়ানা হতে আগত বিখ্যাত সুফী সাধক হযরত কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর সম্মানার্থে এটি নির্মিত হয়।
কুতুব মিনার বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিয়ে গঠিত যা বারান্দা দ্বারা পৃথককৃত। মিনার লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরি যার আচ্ছাদন এর উপরে পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা। ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত এর দরুন মিনার এর কিছু ক্ষতি হয় কিন্তু সেটি পুনরায় শাসকদের দ্বারা ঠিক করা হয়।
ফিরোজ শাহ এর শাসনকালে মিনার এর দুই শীর্ষতলা বাজ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু তা ফিরোজ শাহ দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল।
১৫০৫ সালে একটি ভূমিকম্প প্রহত এবং এটি সিকান্দার লোদী দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল। কুতুব মিনার এর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে যা “নিরাপদ সীমার মধ্যে” বিবেচিত হয়।
কুতুব মিনারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মনোরম একটি কমপ্লেক্স। ১০০ একর জমির ওপর স্থাপিত এ কমপ্লেক্সে রয়েছে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আলাই মিনার, আলাই গেট, সুলতান ইলতুতমিশ, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ও ইমাম জামিনের সমাধি ও লৌহ পিলার।
এছাড়া মিনারের প্রাচীর গাত্র নানা প্রকারের অলঙ্করণ দ্বারা শোভিত। ভারত বর্ষের প্রথম মুসলিম শাসক ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেক কুতুব মিনারের গোড়া পত্তন করেন। তার তত্ত্বাবধানে ১ম ও ২য় তলা নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে (১২১১-৩৬) সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মিনারের ৩য় ও ৪র্থ তলা এবং শেষে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে ৫ম তলা নির্মাণ সমাপ্ত হয়। ঐতিহাসিকদের অভিমত হচ্ছে, কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ-এর মুসল্লিদের সুবিধার্থে আজান দেওয়ার জন্য কুতুব মিনার ব্যবহৃত হতো। ১ম তলা হতে আজান দেয়া হতো নিয়মিত। সর্বাধিক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এটাকে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগিতা লক্ষণীয়। (সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন