পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : মনের ভাব প্রকাশই হচ্ছে ভাষা। বিশ্বের নানা জাতি-গোষ্ঠীর সমৃদ্ধ ভাষার অন্যতম বাংলা। একটা জাতি কত উন্নত সমৃদ্ধ তার প্রকাশ ঘটায় ভাষার শুদ্ধ-শালীন ব্যবহারে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বাংলার একী হাল! বানান ভুলতো আছেই; ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বদলে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। কেউ বিকৃত করে ভাষার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, কেউবা ভুলভাবে ভাষার চর্চা করছেন। ফেসবুক ব্যবহারকারী তরুণ-তরুণীরা কথোপকথনে ব্যাকরণ বা অভিধানের ধার ধারেন না। তারা কার্যত বাংলা ভাষায় বিষ ছড়িয়ে দূষিত করছেন। ফলে মায়ের ভাষা বাংলা ব্যবহৃত রূপ এমন পর্যায়ে গেছে যা বিকৃতির নামান্তর। মায়ের ভাষা বাংলার বিকৃতি জাতি হিসেবে কি বিশ্বদরবারে আমাদের মর্যাদাহানি ঘটাচ্ছে না? প্রশ্ন হলো বাংলা ভাষার এই বিকৃতির দায় কার?
বাংলা ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কী ভুলিতে পারি’ কবির এই পংক্তির মতোই মায়ের ভাষা বাংলা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। রক্তঝরা ফেব্রুয়ারি এলেই মায়ের ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমেই যেন দায়-দায়িত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বাংলা একাডেমি মাসব্যাপী বই মেলার পাশাপাশি ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে নানান ক্রিয়া-কর্মের আয়োজন করে। সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বাংলা যেন শুধুই ফেব্রুয়ারির বিষয়। দিন যত যাচ্ছে প্রযুক্তিতে উন্নতির ছোঁয়া লাগছে। সামাজিক যোগাযোগে বিপ্লব ঘটিয়েছে প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার। সামাজিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে গেছে ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার। দেশের কোটি কোটি মানুষ এখন ফেসবুকমুখী। কিন্তু ফেসবুকে যে শব্দের বিকৃত ব্যবহারে বাংলা ভাষার সর্বনাশ ডেকে আনছে তা কি আমাদের ভাষাবিদরা চিন্তা করছেন না? চিঠির আদান-প্রদান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে গেছে ফেসবুক। সেই ফেসবুকে ছেয়ে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীদের আপলোড করা বাহারি ছবি। ছবি দিয়ে ‘মি-এন্ড মাই অমুক’ এখন ফ্যাশন হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে-বসে, হেলেদুলে, শুয়ে কত ঢংয়ের ছবি আপলোড হচ্ছে ফেসবুকে তার ইয়ত্তা নেই। ছবি আপলোড-চ্যাট ইনবক্সে ‘লাইক’ প্রার্থনা করা হয়। উঠতি বয়স তথা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখার বাইরে অনেকটা সময় ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
টিভি নাটক, রেডিও জকিদের মধ্যে বাংলা শব্দের বিকৃত উচ্চারণ হরহামেশাই হচ্ছে। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, নাটক ও চলচ্চিত্রে বিশেষ করে বিকৃত ভাষা ব্যবহার বেড়ে গেছে। বিজ্ঞাপনে দেখা যায় ‘আবার জিগায়’ ‘খাইলেই দিশ খোশ’, ‘এক্সট্রা খাতির’ ‘আব্বে মামু’ ‘লমু আর যামু’ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। নাটক-সিনেমায় ফার্স্ট ডেট, হাইজফুল, ছাইয়্যা ছাইয়্যা, লাভ ডট কম, মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে, ফাইস্যা গেছি মাইনকার চিপায়, ফিল্মি কথা বাদ দাও, এক্সটা খাতির নাই, ফিল্মি ডায়ালগ মারতাছ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দায়িত্বশীলরা বাংলা ভাষার এসব বিকৃতির প্রতিবাদ না করায় তরুণ প্রজন্ম এসব বিকৃত শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ফেসবুকে এমন সব শব্দের ব্যবহার দেখা যায়; যা মায়ের ভাষার বে-ইজ্জতির নামান্তর। ফেসবুকে দেখা যায়, কিছু শব্দকে সংক্ষিপ্ত করে কিছু শব্দকে বিকৃত করে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলা ভাষার শব্দের ওপর এই কাঁচি চালানোর পরও বাংলা একাডেমিসহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো নীরবতা পালন করছে। বাংলা ভাষা, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির দায়িত্ব শুধু যেন ফেব্রুয়ারি এলেই বইমেলার আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এমন সব আজগুবি শব্দের ব্যবহার হচ্ছে যা মায়ের ভাষার প্রতি চরম অবমাননাকর। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ফেসবুক আসক্তির পাশাপাশি যেন বাংলা ভাষায় নোংরা বিকৃত শব্দের প্রতি আসক্তি বেড়ে গেছে। বন্ধু-বান্ধবীদের অবজ্ঞা করে তারা নতুন নতুন যে শব্দযুগল ব্যবহার করছে তা কি বাংলা ভাষার সঙ্গে যায়? যেমন মাঞ্জা মারা, পল্টিবাজ, হুদাই প্যাচাল, তেলবাজ, চালবাজ, তারছিড়া, কুফালাগা, গুষ্ঠি কিলাই, বেইল নাই, যাইগা বাদ দে, আরে মামু, প্যাচগি মারে, সুইসাইড খামু, ঠ্যাক দিছে আল্টামডান, কইছে তরে, কঠিন চেহারা, মাইনকাচিপা ইত্যাদি। এ সব শব্দ কী বাংলার আদি শব্দ? নাকি বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ? ফেসবুকে এসব শব্দের ব্যবহার ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাওয়ার দায় কার? ফেসবুকে ব্যবহৃত এ শব্দগুলো শুদ্ধ বাংলা ভাষা তো নয়ই দেশের কোনো জেলার আঞ্চলিক ভাষাও নয়। শুধু অশ্লীল শব্দের ব্যবহার নয়; পাশাপাশি ভুল শব্দের ব্যবহারও বেড়ে গেছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। যেমন ‘একটা ফাটাফাটি মুভি’ ‘সেইরাম ব্যাপুক বিনুদুন’ ‘কাইলকা পরীক্ষা, কিছুই পড়িনাইক্যা’। এগুলো কোন ভাষার প্রকাশ?
ফেসবুকে বাংলা ভাষাকে ইংরেজি শব্দে লেখার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। এতে প্রকৃত শব্দের বিকৃতি ঘটছে। আবার সংক্ষিপ্ত ভাবে শব্দের ব্যবহারে বিকৃত হয়ে ‘মূল শব্দই’ হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি ফেসবুক অনুসন্ধান করে বাংলা ভাষার শব্দের ব্যবহারে দেখা গেল কোথাও শব্দকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে বিকৃত করা হচ্ছে। আবার শব্দ ছোট করতে গিয়ে ভুল শব্দের ব্যবহার হচ্ছে। যেমন ‘এসেছ’ শব্দকে ‘আসছ’ ‘করেছিস’ শব্দকে ‘করছিস’, ‘তাহলে’ শব্দকে ‘তাইলে’, ‘কোথায়’ শব্দকে ‘কই’, ‘ওটা’ শব্দকে ‘ওইটা’, ‘ওগুলো’ শব্দকে ‘ওইগুলা’, ‘পাঁচটা’ শব্দকে ‘পাসটা’, ‘খরচ’ শব্দকে ‘খরছ’, ‘ধরে’ শব্দকে ‘ধইরা’, ‘কেন’ শব্দকে ‘ক্যা/কিয়াল্যাই’, ‘কাকে’ শব্দকে ‘কারে’ ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ফেসবুকে এ সব শব্দের ব্যবহার করছেন তারা কখনো বাংলা অভিধানের প্রকৃত শব্দ দেখেন না। কারণ, তারা ফেসবুকেই একজনের বক্তব্যের জন্য নিজেরাই জুতসই শব্দের মাধ্যমে দিচ্ছেন। বাংলা ভাষার শব্দের এই বিকৃত ব্যবহার নতুন প্রজন্মকে কী বার্তা দিচ্ছে? চলতে ফিরতে রাস্তাঘাটে প্রায়ই কানে আসে ‘আর কস না মামা, এই জিএফটাকে নিয়ে ব্যাপক প্যানার মইধ্যে আছি’ ‘এমতে ক্লাস’, ‘এক্সাম নিয়ে আছি দৌরের উপ্রে’, ‘মাঝে মইদ্যে মুঞ্চায় ব্রেকআপ কইরা ফালাই’ ‘আবে হালা’ ‘মামা কমনে আছো’ ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে কথ্য ভাষার সংক্ষিপ্তকরণ ও উচ্চারণের বিকৃতি বাংলা শব্দের অধিক ব্যবহারে ভাষার মূল শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার নামে এমন হাজার হাজার বিকৃত শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে যার বিস্তৃতি ঘটছে এক মুখ থেকে অন্য মুখে। আভিধানিকভাবে এ সব ভাষা বা শব্দ স্বীকৃত নয়। অথচ বিকৃত শব্দের ব্যবহার বাড়ছেই। আমাদের পূর্ব পুরুষরা বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছেন। বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের গৌরবের, অহংকারের। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮টি ভাষার প-িত ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘মাতা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা পরম শ্রদ্ধার বস্তু। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি পরে বিদেশী ভাষার গোড়াপত্তন’। অথচ আমরা বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে শেখার বদলে বুঝে না বুঝে মায়ের ভাষাকে কতই না অবজ্ঞা করছি। বাংলা ভাষার শুদ্ধতা না শিখেই ইংরেজি মিলিয়ে বাংলিশ ভাষায় অভ্যস্ত হচ্ছি। এর মধ্যে কী প্রমাণ মেলে না একুশের চেতনা আমাদের মধ্যে ফিকে হয়ে যাচ্ছে?
শিশু জন্মের পর মায়ের কাছে ভাষা শেখে। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। অ আ ক খ মাতৃভাষা বাংলার বর্ণমালা। এই ভাষাকে নিজের করে পেতে ’৫২-তে রক্ত ঝরাতে হয়েছে। মায়ের ভাষাকে শ্রুতিমধুর, শুদ্ধ, পরিশীলিত করার জন্য রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রতি বছর জনগণের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ বাংলা ভাষার বিকৃতিতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাষা বিকৃতি রোধে তাদের কোনো পদক্ষেপ নেই। বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি এলেই মাসব্যাপী বই মেলা করেই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ। মা’কে ‘মা’ ডাকতে যেমন কোন দিনক্ষণ মাস লাগে না; তেমনি ভাষার উৎকর্ষ সাধনে গবেষণা চিন্তা-চেতনায় নির্দিষ্ট কোন দিবস-মাসের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আমাদের দায়িত্বশীলরা পদ-পদবীতে বসে শুধুই তোষামোদিতে ব্যস্ত। নাটক-সিনেমা এবং ফেসবুকে যে বাংলা শব্দের বিকৃতির মচ্ছব চলছে। ফেসবুকে বাংলা ভাষার সংক্ষিপ্ত রূপের নামে বিষ ছড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। নতুন প্রজন্ম না জেনে না বুঝে মায়ের ভাষায় যে বিষ ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে তা ঠেকানোর দায় কার?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।