Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শেয়ারবাজার সক্রিয় কারসাজিচক্র

প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২১ এএম, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

* লেনদেন ও সূচকে গতি ফিরেছে
* স্পর্শকাতর ও গোপন তথ্য ফাঁস করে লেনদেন ও দামে প্রভাব ফেলছে অসাধুরা
* তথ্য ফাঁসের অভিযোগে তদন্ত দল মাঠে
* গুজব রোধে কাজ করবে ডিএসই
ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : মন্দা কাটিয়ে শেয়ারবাজারে লেনদেন ও সূচকে গতি ফিরেছে। এই গতিশীল স্বাভাবিক বাজার ধরে রাখার জন্য সরকার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই চেষ্টা করছে। তবে কিছু অসাধু কর্তাকর্তা ও শেয়ার ব্যবসায়ী যোগসাজশ করে ক্রয়-বিক্রয়ের মতো অতি স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় তথ্য আগাম ফাঁস করে লেনদেন ও দামে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া ফেইজবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক হারে গুজব ছড়াচ্ছে কারসাজিচক্র। এদিকে, তথ্য ফাঁস হওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত দল মাঠে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্পর্শকাতর বিষয়ে গুজব জড়ানো বন্ধ করতে ডিএসই কাজ করবে বলে জানা গেছে।
বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ.বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য প্রকাশ করে নির্দিষ্ট কোন শেয়ারে আগ্রহ তৈরি করা চক্রের লক্ষ্য থাকে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকে পড়লে চত্রু লাভবান হয়। এক্ষেত্রে কেউ যদি যোগসাজশ করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া উচিত। গুজবে কান না দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে শেয়ার কেনার পরামর্শ  দিয়েছেন তিনি।
পর্যোলোচনা করে দেখা গেছে, পুঁজিবাজার নিয়ে ফেইজবুকে অসংখ্য আইডি আছে। বেশিরভাগ আইডির অ্যাডমিন মূলত বাজারের কারসাজিচক্রের সদস্য। তবে কিছু আইডি থেকে ভালো পোস্টও দেয়া হয়। কারসাজিচক্র যে কোম্পানিতে শেয়ার কেনে ওই কোম্পানিকে লক্ষ্য করে দাম বাড়ার গুজব ছড়াতে শুরু করে। যাতে করে ওই কোম্পানি শেয়ার কেনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের বেশি আগ্রহ তৈরী হয়। ওই সময় তাদের হাতে থাকা শেয়ার চক্রটি বিক্রি করে দেয়। এতে করে বিনিয়োগকারীরা বেশি দামে শেয়ার কিনে ক্ষতি মধ্যে পড়ে বলে জানিয়েছে বাজার বিশ্লেষকরা।
দেখা যায়, গত ২১ তারিখে পুঁজিবাজার ডিএসই নামের ফেইজবুক আইডি থেকে ন্যাশনাল টিউবস কোম্পানির পোস্ট দিয়েছে। তাতে লেখা হয়, শেয়ার দাম দশ দিনের মধ্যে ১৮০ টাকা হবে। এছাড়া ওই কোম্পানির ছবি দেওয়া হয়েছে। কমেন্টে অনেক লিখেছেন, কোন খবর আছে নাকি? আবার আইডিধারীকে অনেক কারসাজি হিসাবে মন্তব্য করেছে। এছাড়া ওই আইডি থেকে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ফেইবুকে এসএমএ করে এ তথ্য প্রচার করেছে। এসএমএ পাওয়া একজন তার উত্তরে লিখেছেন, আপনি কেন আমাকে এই এসএমস দিয়েছেন? এত যদি বোঝেন নিজে কিনে বসে থাকুন। এত প্রচারণার দরকার কি?
অথচ গতকাল ন্যাশনাল টিউবসের শেয়ার দর ছিল ১১৭ টাকা। আর ওই পোস্ট দেওয়ার দিন ছিল ১৩২ টাকা। এ হিসাবে ছয় কার্যদিবসে ১৫ টাকা কমেছে। এদিকে ওই আইডিতে আরএকে সিরামিকের দাম কয়েকদিনের মধ্যে ১০০ টাকার কথা বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে ওই কোম্পানি শেয়ার দর ৬৮ টাকায় অবস্থান করছে। ফেইজবুকে এই ধরনের আরো ৫০টির মতো বিভিন্ন নামে আইডি আছে। যা থেকে প্রতিনিয়ত এই ধরনের বিভ্রন্তমূলক পোস্ট দেয়া হয়। শুধু ফেইজবুক নয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রায় সব ধরনের আইডি থেকে প্রতারণারমূলক গুজব ছড়ানো হয়।  
এসব চক্রের কর্মকা- এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে। তাদের সতর্ক করে ডিএসই’র ওয়েবসাইটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বারবার শিরোনাম আকারে প্রচার চালানো হচ্ছে। এতে লেখা আছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সময় অননুমোদিত উৎসের (যেমন: ফেইসবুক ইত্যাদি) কোন তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। কারণ লাভ না লোকসান যায় হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে আপনারই।
জানা যায়, শেয়ারের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (সিএসই)। এর মধ্যে সিডিবিএলে বিনিয়োগকারীদের সব শেয়ার সংরক্ষিত থাকে। অন্যদিকে বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই তাদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে লেনদেন মনিটর করে থাকে। এই চারটি প্রতিষ্ঠানের যে কোনো এক বা একাধিক জায়গা থেকে এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা টাকার বিনিমিয়ে লেনদেনের তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের স্বার্থে লেনদেনের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখা উচিত। লেনদেন ও শেয়ার ধারণের তথ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আমানত। এই আমানত রক্ষা করা সংশ্লিষ্টদের পবিত্র দায়িত্ব। যেহেতু চারটির বেশি জায়গা থেকে তথ্য ফাঁসের সুযোগ নেই, তাই ওই চারটি জায়গায় নজর দিলেই তা বন্ধ করা সম্ভব বলে তারা মত দিয়েছেন।
এদিকে তথ্য ফাঁসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। বিশিষ্ট তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও বুয়েটের শিক্ষক এম কায়কোবাদকে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপর দুই সদস্য বুয়েটের প্রফেসর মোঃ মোস্তফা ও প্রফেসর ড. ইউনুস আলী। এই কমিটি তথ্য ফাঁস রোধের উপায় সম্পর্কে সুপারিশ করবে। তদন্তে তথ্য ফাঁসের প্রমাণ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া সিকিউরিটিজ হাউজগুলোতে কিছু শেয়ার ব্যবসায়ী প্রতিদিনই কয়েকটি কোম্পানি টার্গেট করে দাম বাড়া-কমার গুজব ছড়ায়। এমনকি লেনদেনকারী কর্তকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে বাজার সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিনিয়োগকারী বলেন, গতকাল বাজারে পতন থাকায় আমি একটি কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য বললাম। কিন্তু এক কর্মকর্তা আমাকে নানানভাবে বুঝিয়ে আর একটি কোম্পানির শেয়ার কিনে দিয়েছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শেয়ার কেনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের ব্যক্তিরা কারসাজি চক্রের সাথে জড়িত থাকতে পারে।
এদিকে ডিএসই’র ওয়েবসাইটে বিনিয়োগকারীদের গুজবে কান না দেয়ার জন্য সতর্কীকরণ দেয়া আছে। ‘শেয়ার কেনা-বেচার সময় গুজবে কান দেবেন না। গুজবে শেয়ার কেনা-বেচা ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি গুজব রটানোও আইনানুগভাবে নিষিদ্ধ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির রোববার মুদ্রানীতি প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ২০১০ সাল থেকে শেয়ারবাজারে বিরাজমান মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি যাতে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণে থাকে এ বিষয়ে কার্যকর নজরদারি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে অতীতের মতো এবারও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ইতোমধ্যে ডিএসই তদন্তে নেমেছে। সত্যি সত্যি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী শেয়ার লেনদেনের গোপন তথ্য পাচার করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের কাজের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, ফেইজবুকসহ যে সব মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে, তারা বড় ধরনের অপরাধ করেছে। তাদের বিষয়ে আলোচনা হবে বলে তিনি জানান। বিনিয়োগকারীদের এসব গুজবে থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।



 

Show all comments
  • রাজিব ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৩৯ পিএম says : 0
    ডিএসইকে শক্ত হাতে এগুলোকে দমন করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • আসিফ ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৪০ পিএম says : 0
    এই অসাধু চক্রের হাত থেকে ডিএসইকে বাঁচানো না গেলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে।
    Total Reply(0) Reply
  • Jamal ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৪১ পিএম says : 0
    thanks to the reporter for this brilliant news
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেয়ার বাজার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ