হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : আমাদের শৈশব-কৈশোরেই জেনেছি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একজন মহাকবি আছেন, তিনি মহাকবি কায়কোবাদ (প্রকৃত নাম-কাজেম আল কোরায়শি), যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের আগে জন্মেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে বছর বাংলার মুক্তিকামী বীর সেনানীরা বিদ্রোহ করেছিল, সেই সিপাহী বিদ্রোহের বছর ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জে এই মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল। দীর্ঘ ৯১ বছরের সৃষ্টিশীল কীর্তিময় জীবন শেষে তিনি ১৯৫১ সালে ২১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। আজ ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ, অর্থাৎ ভাষা শহীদের স্মৃতি বিজড়িত মাসটি বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। রমনায় আয়োজিত বাংলা একাডেমির সাংবাৎসরিক বিশাল কলেবরের একুশে গ্রন্থমেলাও এখন শেষপাদে। বাংলা একাডেমি এবং সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত বইমেলার বিভিন্ন পয়েন্টে দেশবরেণ্য নানাজনের পাশাপাশি অখ্যাত, বিতর্কিত ব্যক্তিদের নামে ‘চত্বরের’ নামকরণ করা হলেও কায়কোবাদের নামে কোন চত্বর চোখে পড়েনি। অথচ তিনি বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সাধনায় অনন্য গৌরবের স্রষ্টা। তাকে বিস্মৃত হওয়া মানে শেকড়ের প্রতি, বিস্মরণ অবজ্ঞা-অবহেলা করা।
প্রতিটি জাতি এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কিছু সুনির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, প্রথা বা রিচুয়াল থাকবে, যা’ প্রতিবেশী অন্য সম্প্রদায়ের লোকজ সংস্কৃতির সাথে তার ভিন্নতা বা পার্থক্য সূচক বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে। বাঙালি মুসলমানের ঘরে সন্তান জন্মের সাথে সাথে তার কর্ণকুহরে আযানের ধ্বনি পৌঁছে দেয়ার একটি রেওয়াজ আছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদের নাগরিক জীবনে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পুরনো দাই-ধাত্রীদের জায়গায় সিজারিয়ান কালচার বহুলাংশে জায়গা করে নিলেও এখনো হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের পাশে উৎগ্রীব অপেক্ষমান নানী-দাদীরা নবজাতকের কানে বিড়বিড় করে আযানের সুর পৌঁছে দিতে ভুল করেন না। বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যে এবং লোকজ সংস্কৃতিতে আযান একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আযান মানে নামাজের জন্য আহ্বান, যেখানে শান্তি ও কল্যাণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। জন্মের পর সন্তানের কানে আযান দেয়া হলেও এটি একটি প্রতীকী আযান, এই আযান শেষে কোন নামাজের জামাত হয় না। তবে আযানের কথা উঠলেই কবি কায়কোবাদের সেই বিখ্যাত কবিতার চরণগুলো স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, আনমনে আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করে- ‘কে ঐ শোনালো মোরে আযানের ধ্বনি,/মর্মে মর্মে সেই সুর,/বাজিল কি সুমধুর,/আকুল হইলো প্রাণ, নাচিল ধ্বমনি/কি মধুর আযানের ধ্বনি’...।
অথবা আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের গিতি কবিতা-
দূর আযানের মধুর ধ্বনি/বাজে বাজে মসজিদেরও মিনারে/
এ কী খুশির অধীর তরঙ্গ/উঠলো জেগে প্রাণের কিনারে...।
মনে জাগে হাজার বছর আগে/ডাকিত বেলাল এমনি অনুরাগে...।
অথবা, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
সারাবিশ্বের মুসলমান জাতীয়তাবাদি অথবা ধর্মভীরু কবিরা আযান ও নামাজের অপার্থিব আকর্ষণ ও আনন্দের রস বিলিয়েছেন। আজকের তথাকথিত প্রগতিশীল ও নাগরিক সমাজের শেকড় বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, শব্দরোধি কাঁচের ঘরে শুয়েও আযানের ধ্বনিতে বিরক্তবোধ করেন, দিনভর নিজেদের গাড়ির হর্ণ বাজাতে বাজাতে, কালোধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মসজিদের আযানের ধ্বনিতে শব্দদূষণের উৎস খোঁজেন। তারা কি গির্জার ঘণ্টাধ্বনি বা মন্দিরের শঙ্খধ্বনিতেও শব্দদূষণের মাত্রা আবিষ্কার করবেন?
এতদিন দেখা যেত থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে উঠতি বয়েসী তরুণ-তরুণীরা নিজেদের বাড়িতে অথবা কোন হোটেল-রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টি দিচ্ছে বা অভিজাত পাড়ার ক্লাবগুলোতে রাতভর আনন্দ-ফুর্তির একটি কালচার আমাদের শহুরে সমাজে একটি চেনা বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও শহরের যুব সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশই এই অপসংস্কৃতিতে গা ভাসায়। থার্টিফাস্ট নাইট এবং পহেলা বৈশাখের আনন্দ র্যালিতে বখাটে যুবকদের উন্মত্ত-উচ্ছৃঙ্খলতায় নারীর সম্ভ্রমহানির ঘৃণ্য ঘটনা কখনো কখনো জাতীয় লজ্জায় পরিণত হয়েছে। গত বছর থেকে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থার্টিফার্স্ট নাইট এবং পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানাদিতে বাড়তি নজরদারি এবং বিধি নিষেধ আরোপ করায় বখাটে তরুণদের প্রকাশ্য উন্মত্ততা হয়তো কমে আসবে। কিন্তু অসংখ্য কিশোর-তরুণের চেতনায় নানাভাবে যে হেডোনোস্টিক কালচারের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তার থেকে উত্তরণের পথ আপাততঃ আমাদের জানা নেই। ইদানীং ঢাকা শহরে এক অদ্ভুত অপসংস্কৃতির ভয়াল থাবা বিস্তার লাভ করতে দেখা যাচ্ছে। তা হচ্ছে বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদে, এমনকি কেউ কেউ জন্মদিন বা মুসলমানির আয়োজনেও রাতভর ডিজে পার্টির আয়োজন করছে। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল কেউ কেউ সেলিব্রেটি বা ‘সেরাকণ্ঠে’র গায়ক-গায়িকাদের এনে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি গান গাওয়াচ্ছে। লাখ টাকা খরচ করে এ ধরনের ডিজেপার্টি বা লাইভ কনসার্ট করতে অপারগ এমন বেশিরভাগ পারিবারিক উৎসবগুলোতে ছেলে-মেয়েরা বাড়ির ছাদের ওপর বিশালাকারের সাউন্ডবক্স বসিয়ে স্বল্প পরিচিত উঠতি কণ্ঠশিল্পী এনে অথবা প্রজক্টরে হিন্দিগানের সিডি চালিয়ে রাতভর উদ্দাম নাচানাচিতে পুরো মহল্লা মাতিয়ে রাখে। মসজিদের সুউচ্ছ মিনার থেকে আসা এক- দেড় মিনিটের আযানের ধ্বনি যাদের কাছে বিরক্তি এবং শব্দদূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তারাই প্রতিবেশীদের ঘুম নষ্ট করে সারারাত ধরে হিন্দিগানের ডিজেপার্টিকে আধুনিক সংস্কৃতির আবাহন হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। এ অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি।
ঢাকার এক বিশিষ্ট নাগরিক প্রাত্যহিক আযানের ধ্বনিতে সম্প্রতি নিজের বিরুক্তি প্রকাশ করেছিলেন। গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার পর তিনি দুঃখ প্রকাশ করে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে যারাই আযানের ধ্বনি অথবা ইসলামের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন, প্রত্যেকেই গণধিকৃত-প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। জনরোষ এড়াতে কেউ কেউ দেশ ছাড়তেও বাধ্য হয়েছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আঘাতকারী এসব ব্যক্তির সগোত্রীয় ব্যক্তিরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবি করে থাকেন, আর তাদের বিরুদ্ধে যারা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখান তাদের ভাষায় তারা হচ্ছেন মৌলবাদি অথবা প্রতিক্রিয়াশীল। এ কথা সত্য হলে এখনো আমাদের সমাজে মৌলবাদি বা প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের সংখ্যাই বেশি। যদিও আন্তর্জাতিকভাবেই আমরা ইতিমধ্যে একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। হাজার বছর ধরে এ দেশের হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখে একটি বৈচিত্র্যময় বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি অদৃশ্য শক্তির সেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ এবং এ দেশের মুসলমানদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নস্যাতের অশুভ প্রয়াস চালাতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের হাত ধরে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা এখন চরম সামাজিক অবক্ষয় ও নির্মম অনাচারে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি এবং শিশু হত্যার মত নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধির জন্য আমরা যখন সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা বলছি, তখন এসব নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পেছনের কারণগুলো উৎঘাটনের চেষ্টা না করেই কেবলমাত্র সরকারের ব্যর্থতা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে ঘুরপাক খাচ্ছি। আজকে আমরা যে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি তা’ হাঠাৎ করেই শুরু হয়নি। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে জড়িত প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারেরই কমবেশি দায় রয়েছে।
দেশে তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যতই বাড়ছে, প্রজ্ঞাবান মানুষের সংখ্যা ততই যেন কমছে। শিক্ষানীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা কারিকুলাম থেকে প্রজ্ঞাবান মানুষ তৈরির উপযোগী বিষয়গুলো ক্রমে অবলুপ্ত হতে চলেছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা কারিকুলাম থেকে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ আশ্রিত বিষয়গুলো বাদ দেয়ার ফলে শিক্ষাব্যবস্থা জাতিসত্তার বিকাশের মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে। স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে ইসলামের শিক্ষা এবং ইসলামের ইতিহাস নির্ভর কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধগুলো বাদ দিয়ে সেক্যুলার ও হিন্দু সংস্কৃতির অনুকূল বিষয়াবলী সংযুক্তির অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একটি ফেইসবুক আইডি থেকে শেয়ার করা এক পোস্টে লেখক, প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সিলেবাস থেকে যেসব বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে এবং এর বদলে যেসব বিষয় পাঠ্য বইয়ে ঢোকানো হয়েছে তার একটি আংশিক ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন, যাÑ রীতিমত বিস্ময়কর এবং হতাশাজনক। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী মূল্যবোধ ও শেকড় বিচ্ছিন্নতার শিক্ষা প্রচলনের ফলে আমাদের সমাজ যে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করি, চলমান সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অপসংস্কৃতির আস্ফালনে যুব সমাজের গা ভাসিয়ে দেয়া, মাদক, অবাধ যৌনাচার এবং শিশু হত্যার নিষ্ঠুরতার মধ্যে তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের রাষ্ট্র এবং জাতিসত্তা গঠনের পেছনে হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। এরই শেষ পর্যায়ে এসে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, অতঃপর পাকিস্তানী শাসকদের অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে তিনি বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা আমরা বাঙালি, আমরা মুসলমান।’ বাঙালিত্ব এবং মুসলমানিত্বের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এখানে সাংবিধানিকভাবে ধর্ম, জাতপাত এবং অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদ অগ্রাহ্য করে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন যদি কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিলীন করে দিয়ে বৃহত্তর বাঙালিত্বের পক্ষে সাফাই গাইতে চায়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সেটা স্পষ্টতই আমাদের জাতিসত্তা এবং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। আমাদের স্বাধীনতা এবং বিশাল ভারতের পাশে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রথমেই আমাদের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যতে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কেউ কেউ কোন অদৃশ্য প্রভাবে আমাদের ধর্ম ও জাতিসত্তা বিরোধী বিষয়বলী প্রবিষ্ট করার প্রয়াস চালাচ্ছে কিনা, এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সুস্পষ্ট অবস্থান ও ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
ইসরাইলী সাংবাদিক লেখক জোনাথন কুকের লেখা একটি নিবন্ধ সম্প্রতি আল-জাজিরা অনলাইনে প্রকাশিত হয়। যেখানে কুক দেখিয়েছেন, পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে অবস্থানরত ফিলিস্তিনি শিশুদের পাঠ্যক্রম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইসরাইল সরকার কিভাবে এসব শিশুকে জায়নবাদি চেতনায় গড়ে তোলতে চাইছে। সেখানে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিশুদের এই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, তারা ভবিষ্যতে হয়তো বলবে, আল-আকসা মুসলমানদের হলি প্লেস বা পবিত্র স্থান নয়। ফিলিস্তিনের শিক্ষামন্ত্রী সাবরি সাইদাম মিডিয়ায় বলেছেন, শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইসরাইল তাদের অবৈধ দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করতে চাইছে। ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পূর্ব জেরুজালেম দখল করার পর থেকেই সেখানকার মুসলমান শিশুদের উপর ইসরাইলী শিক্ষা কারিকুলাম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রথমতঃ একটি দেয়াল নির্মাণ করে পশ্চিম তীর থেকে পূর্ব জেরুজালেমকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অতঃপর পূর্ব জেরুজালেমের মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ও মনস্তাত্বিক পরিকাঠামোতে পরিবর্তন সাধনের মধ্য দিয়ে ইসরাইলীরা ধীরে ধীরে একটি দূরবর্তী লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। যখন সেখানকার ফিলিস্তিনীরা বলবে, আল-আকসা মুসলমানদের নয় ইহুদিদের পবিত্র স্থান এবং এরিয়েল শ্যারন একজন জাতীয় বীর। ইসরাইলের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই মুসলমান অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে চলেছে। অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের চেতনা এবং প্রতিরোধ সংগ্রামকে দুর্বল করতে তাদের শিশুদের মন-মগজে জায়নবাদের বীজ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণ এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সচেতনতার কারণে তারা সহজেই বুঝতে পারছে তাদের শিক্ষা কারিকুলামে গলদটি কোথায় এবং কেন। এ কারণেই হয়তো ইসরাইলীদের লক্ষ্য অর্জন শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হবে। ইসরাইলী দখলদারিত্ব থেকে আল-আকসা মুক্ত করার চেতনার শপথ থেকে ফিলিস্তিনি শিশুরা কখনো বিচ্যুত হবে না। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম থেকে কায়কোবাদ, নজরুল, কাদের নওয়াজ, ড. শহীদুল্লাহর মত লেখক সাহিত্যিকদের লেখা ইসলামের নবী-রাসূল, খলিফাদের জীবনী ও শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক লেখাগুলো বাদ দিয়ে অখ্যাত, বিতর্কিত লেখকদের ততোধিক বিতর্কিত লেখা দিয়ে ভরিয়ে তোলার যে অভিযোগ উঠেছে, তার কোন ব্যাখ্যা বা জবাব আমাদের হাতে নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা কারিকুলামের রদ বদল ও ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও আমাদের শিক্ষক সমাজ ও নাগরিক সমাজের কোন ভূমিকা বা প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি। অনেকটা নীরবেই আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে বড় ধরনের মেটামরফসিস ঘটে গেছে। এর ফলে আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং জাতিসত্তার চেতনা ভোতা হয়ে যাচ্ছে। হিন্দি সিরিয়াল ও ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সংস্কৃতিকে অনেকেই নিজেদের সংস্কৃতি বলে মনে করতে শুরু করেছে। পাঠ্য বই থেকে ইসলামের ইতিহাস ও নৈতিক শিক্ষামূলক লেখাগুলো ছাঁটাই করে ফেলার কারণে বিজাতীয় সংস্কৃতির সাথে নিজেদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পার্থক্য অনুধাবন করা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী জাতিরাষ্ট্র অবক্ষয়ের চরমসীমায় পৌঁছে নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকেও দুর্বল এবং আত্মরক্ষায় অক্ষম করে তুলতে পারে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজে রাজনৈতিক বিভাজনকে প্রকট করে তোলে। এ ধরনের বিভাজিত সমাজ সাম্রাজ্যবাদি ও আধিপত্যবাদি শোষণের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমরা আমাদের দেশকে এ ধরনের বিভাজন ও শোষণের চারণভূমিতে পরিণত হতে দিতে পারি না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।