Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা নারীই মিয়ানমারে ধর্ষিত

| প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কুটনৈতিক সংবাদদাতা : বাংলাদেশ সফররত আনান কমিশনের প্রতিনিধিদলের প্রধান লেবানিজ নাগরিক ঘাশাম সালামেহ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হলে আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে তাদের নিয়ে যে সমস্যা তার অনেকটাই সমাধান হবে। সেই সাথে তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্ট্যাডিজ (বিস) কার্যালয়ে সুশীল সমাজের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এর আগে গতকাল সকালে আনান কমিশনের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয়
অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এবং বিকেলে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন।
আনান কমিশনের প্রতিনিধিদলে রয়েছেন মিয়ানমারের নাগরিক উইন ম্রা ও আই লুইন এবং লেবানিজ নাগরিক ঘাশাম সালামেহ। বিস-এ মতবিনিময় সভায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ইমতিয়াজ আহমেদ, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট’-এর (রামরু) অধ্যাপক সি আর আবরার ও অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী, ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুর্শিদ, পররাষ্ট্রসচিব মো. শহিদুল হক, সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুম কুমার চাকমা, বিসের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মুনশি ফয়েজ আহমদ প্রমুখ।
ঘাশাম সালামেহ সাংবাদিকদের বলেন, গত অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান চালানোর পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা দেখতে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। বিশেষ করে, ওই সময় থেকে রোহিঙ্গারা কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এসেছেন, সেটা জানাটাই তাদের এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য।
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো উপাদান আছে কি না-তা জানতে চাইলে সালামেহ বলেন, একমাত্র ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের ফলেই যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে এসেছেন, তা নয়। এ সঙ্গে তাদের অধিকার, নাগরিকত্ব ও জীবিকার প্রশ্নগুলোও জড়িত। কাজেই তাদের নাগরিকত্বের সমস্যা সমাধান করাটাই অন্যতম প্রধান বিষয়।
গতকাল সকালে আনান কমিশনের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা- নাগরিকদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমার এরইমধ্যে সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এর পথ ধরেই আনান কমিশন গঠিত হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথে এটি বড় অগ্রগতি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিলে রাখাইন প্রদেশের সব সমস্যার সমাধান হবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে ঘাসাম সালামেহ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে।
ধর্মীয় কারণে আরাকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হচ্ছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকগুলো কারণে মধ্যে এটি একটি কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এসব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি।
এরপর গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ে নিজ কক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কমিশন সদস্যরা। সাক্ষাৎ শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ নারী মিয়ানমারেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে তাকে জানিয়েছেন সফররত কফি আনান কমিশনের সদস্যরা। আর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ লাখ হতে পারে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কফি আনান কমিশনের সদস্যরা রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের অভিযোগের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তাদের কোনো দ্বিমত নেই। কমিশন সদস্যরা অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে গত ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন কফি আনান কমিশনের তিন সদস্য। এরপর গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন। ওই সময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও), জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচসিআর) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গারা প্রতিনিধিদলের কাছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। তারা গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে একটি চিঠিও প্রতিনিধিদলের কাছে হস্তান্তর করেন। ওই চিঠিতে এলাকা, স্থান ও সময় উল্লেখ করে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে অন্তত ৫০টি মসজিদ, ৫৪টি ধর্মীয় স্কুল ও তিন হাজার ৩২৯টি ঘরবাড়ি, ১৯৬টি দোকানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে আরো উল্লেখ করা হয়, ৭৯৮ জন নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ, ৪৬৯ জনকে গুলি করে হত্যা, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালিয়ে খুন করা হয়েছে ১০৮ জনকে, নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৭৮ জনকে এবং ৯২০ জনকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের জনগণের কল্যাণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ তৈরির জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সুচি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেন। রাখাইন রাজ্যের সব নাগরিকের মানবিক ও উন্নয়ন, নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপাদানগুলোকে নিয়ে কমিশন সুপারিশ তৈরি করবে। কফি আনান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় মিয়ানমারের ছয় নাগরিক ও তিন বিদেশি বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গঠিত এই কমিশন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ