Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অস্তিত্বসংকটে মাথাভাঙ্গা পুনঃখননের দাবি

প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে : বৈশাখ মাস আসতে এখনও দুই মাস বাকি। এখনই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ছোট নদীর মত অবস্থা দাঁড়িয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একমাত্র স্রোতস্বীনি নদী মাথাভাঙ্গা। প্রতিকুল পরিবেশ, নানা অনিয়ম ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে অস্তিতসংকটে পড়ে ঐতিহ্য হারিয়ে নদীটি এখন মৃতপ্রায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই চুয়াডাঙ্গা জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এ নদীটি। অতীতে এ জেলার নদীর গতি ছিল যেমন বিচিত্র তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রধান নদী মাথাভাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। বহু বছর আগে এ নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি বিশাল জনপদ। এই নদীকে ঘিরেই এক সময় এ বিশাল জনপদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাহ করতো তাদের জীবন-জীবিকা। জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদী মাথাভাঙ্গা পদ্মার দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। এ নদী একসময় খুব স্রোতস্বীনি ছিল। জনশ্রুতি আছে, বহু বছর আগে উৎস্যমুখে মূল নদী পদ্মার সাথে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাথা বা মুখ ভেঙ্গে যাওয়ায় নদীটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে কোন এক সময় এ নদীটি হাওলিয়া বা হাওলি নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬২ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলার সাথে কোলকাতার রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কোলকাতার সাথে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। এ নদীপথে বড় বড় নৌকায় নানরকম পণ্য আনা-নেয়া করা হতো। পদ্মা নদী থেকে জলঙ্গী নদীর উৎপত্তি স্থানের প্রায় ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া ও হাটুভাঙ্গা গ্রামের মাঝদিয়ে মাথাভাঙ্গা নদী এ জেলায় প্রবেশ করেছে। এ জেলায় প্রবেশ করে কিছুদূর আসার পর এ নদীর একটি শাখা বের হয়ে কুমার নদী নামে পূর্বদিকে বয়ে গেছে। মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ২৬টি এবং দামুড়হুদা উপজেলার ১৫টি গ্রাম পেরিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতের নদীয়া জেলায় প্রবেশ করেছে। ভারতে মাথাভাঙ্গা নদী চুর্নী নদী নামে পরিচিত। এরপর এ জেলার ১০-১২টি গ্রাম পেরিয়ে ভাগিরথীর সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মূলতঃ গঙ্গা ও পদ্মার প্রবাহের উপর এতদাঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা নির্ভশীল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় ইংরেজি ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত ফারাক্কা চালু করে। এরপর থেকেই শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহারের ফলে অব্যাহতভাবে পদ্মার পানি প্রবাহ কমতে থাকে। ফলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে মাথাভাঙ্গার উপরও। সেই থেকে মাথাভাঙ্গায় ক্রমান্বয়ে পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় স্রোত কমে গিয়ে পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে নদীটির তলদেশ। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার কারণে বর্তমানে মাথাভাঙ্গা নদী মৃতপ্রায় হয়ে খালের আকার ধারণ করেছে। ফাল্গুন চৈত্র মাসে নদীর পানি এত কমে যায় যে, কোন কোন জায়গায় পানি প্রবাহের উচ্চতা থাকে মাত্র হাঁটু সমান। তারপরও এক শ্রেণীর বিবেকহীন মানুষ নদীর বিভিন্ন স্থানে আড়াআড়িভাবে শত শত বাঁধ দিয়ে, কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকার করছে। তাতে নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধগ্রস্ত হওয়ার ফলে নদী তলদেশ ভরাট হয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে নদীর অকাল মৃত্যু। নদীতে কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকারের ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, আর কিছুদিন পর শুরু হবে মাছের প্রজনন ঋতু। তাই বর্তমানে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে কোমর ঘেরার ফলে মাছের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মাছের বংশ বৃদ্ধিতে এ পদ্ধতি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সরেজমিনে নদীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মাছ শিকারীরা ঘুণি জাল দিয়ে কোমর ঘিরে এমনভাবে মাছ শিকার করে তাতে মাছের ছোটছোট পোনা থেকে ডিম পর্যন্ত উঠে আসে। ফলে এ ব্যবস্থায় মাছের বংশবৃদ্ধি তো দূরের কথা প্রকৃতপক্ষে মাছের বংশ ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়াও নদীর দু’ধারে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রায় সারা বছরই অনেক জায়গায় এক শ্রেণীর মানুষ দুই পাড়ের মাটি কেটে সমান করে সেখানে নানারকম ফসলের আবাদ করছে। ফলে তাতে হাতে গোনা কিছু মানুষ উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলতে থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। বিগত মেয়াদের সরকারের আমলে বেশ কয়েকবার এ নদীটি পুনঃখননের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত তার কোন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সূত্রে জানা গেছে, একসময় এ নদীতে মাছ শিকার করে দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নিজেদের মাছের চাহিদা মেটাতো। অপর দিকে জেলে সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ এ নদীতে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে নদীতে পানি না থাকায় মাছ ধরতে না পেরে অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার অনেকে কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। একসময় এ নদীর পানিই ছিল এ অঞ্চলের নদীতীরের কৃষকদের সেচের একমাত্র অবলম্বন। এ নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষকরা শুষ্ক মৌসুমে নদীর দুই পাড়ের শত শত বিঘা জমিতে নানারকম ফসল ফলাতো। পানি প্রবাহের অভাবে বছরের পর বছর পলি পড়ে বর্তমানে নদীটি তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। এছাড়া বর্তমানে ফসলের জমিতে সেচ দেয়ার জন্য শত শত গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও সেইসাথে ফসলে সেচ দেয়ার জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে অনবরত পানি তোলার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এলাকার জলবায়ুর উপর। ফলে এলাকা পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে। যার কারণে প্রতি বছরই চুয়াডাঙ্গা জেলায় শীতকালে বেশিরভাগ সময় সর্বনিম্ন ও গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে। মাথাভাঙ্গা নদীতে পানি না থাকার কারণে চুয়াডাঙ্গা জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে যন্ত্রচালিত সেচ যন্ত্রেও পানি ঠিকমতো উঠছে না। কষ্ট করে কৃষকদের পানি তুলতে তুলনামূলকভাবে বেশি খরচ গুণতে হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিল-বাওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবায়ও পানি থাকছে না। ধ্বংস হচ্ছে এলাকার জীববৈচিত্র্য। টিউবয়েলে পানি উঠছে না ফলে প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়। বছর বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যে হারে নিচে নামছে তাতে হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন ফসলে সেচের পানির জন্য কৃষককে চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে মালামাল বহনের একমাত্র উপযোগী ছিলো মাথাভাঙ্গা নদী ও ভৈরব নদের নদীপথ। কিন্তু ভারতের ফরাক্কা বাঁধের কারণে পানি প্রবাহ কমে গিয়ে মাথাভাঙ্গা নদী ও ভৈরব নদের নাব্যতা হ্রাস পেতে পেতে বর্তমানে শুষ্কপ্রায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে অত্র অঞ্চলের মানুষের প্রধান দাবির মধ্যে অন্যতম একটি দাবি হয়ে ওঠে মাথাভঙ্গা নদী ও ভৈরব নদ পুনর্খননের। এতে সাড়া দেয় সরকার। ২০১০ সালে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে মুজিবনগর আম্রকাননের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিকভাবে ভৈরব নদ পুনর্খননের প্রতিশ্রুতি দেন। তারই ফলশ্রুতিতে গত বছর ভৈরব নদ পুনর্খননের কাজ শুরু হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল ৭০ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার ২১৬ টাকা ব্যয়ে নদের ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খননকাজ শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সময় নির্ধারিত রয়েছে। অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, ভৈরব-কপোতাক্ষ নদ হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল নদী কাঠামো এবং মাথাভাঙ্গা তার চাবিকাঠি। মাথাভাঙ্গা নদীটি ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে মাথাভাঙ্গা থেকে ভৈরবের উৎসমুখ খুলে দিলেই তার শাখা কপোতাক্ষসহ এ অঞ্চলের সব নদী তাদের হারানো গতি ফিরে পাবে। ফলে এতদাঞ্চলের কৃষি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ নদ-নদীগুলো ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে। তাই এখনই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়া হলে হয়তো আর কয়েক দশকেই বাংলার মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, কপোতাক্ষ নামের এ ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অস্তিত্বসংকটে মাথাভাঙ্গা পুনঃখননের দাবি
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ