Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘স্বাভাবিক’ শেয়ারবাজারে সতর্কতার পরামর্শ

| প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : পুঁজিবাজারের বর্তমান তেজীভাব স্বাভাবিক; এমনকি সূচকের মাথা আরো উপরে থাকাটাও স্বাভাবিক হতো- এমন মতামত জানানোর পরও বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন বিনিয়োগকারীদের। বলেছেন, অবশ্যই এটা বিনিয়োগের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তবে সেটা অবশ্যই ধার-দেনা আর সম্পদ বিক্রি করে নয়। সঞ্চিত পুঁজির সর্বোচ্চ অর্ধেক বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। আর আবশ্যক হিসেবে বলেছেন বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জনের। তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আবারও কেউ যাতে বাজার থেকে অর্থ ‘লুটতে’ না পারে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাই; যদিও বাজারের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর সার্বক্ষণিক সতর্ক দৃষ্টি রাখছে; তথ্য নিচ্ছে প্রতি সপ্তাহান্তর, যে সময়টা আগে ছিল দ্বিগুণ। ডিএসই’ও নিযুক্ত করেছে শক্তিশালী সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম।
বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ.বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, পুঁজিবাজার এখনও স্বাভাবিক, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। তবে সাড়ে ৬ হাজার সূচক পার হলে তখন কিছুটা ভাবনার বিষয় হতে পারে। তবে বাজারে মাঝে মাঝে মূল্য সংশোধন হওয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, যাদের হাতে বাড়তি টাকা থাকে তাদের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। আবার সঞ্চয়ের পুরো অংশও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। মোট সঞ্চয়ের অর্ধেক দিয়ে শেয়ার কেনা যেতে পারে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের বিপরীতে মুনাফা কমে যাওয়ার কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী বাড়ছে বলেও তিনি মনে করে।  
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বছরের শুরু থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন ও সূচক জেগে উঠেছে। লেনদেন প্রতিদিনই বাড়ছে, সঙ্গে সূচকও। ২০১০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৬৪ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকার লেনদেনের রেকর্ড হয়েছে গত সপ্তাহের মঙ্গলবার, ওই দিন ডিএসইতে সূচকও সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়েছে। গতকালও ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৮ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট এবং সিএসইতে প্রধান সূচক সিএসসিএক্স ২১৯ দশমিক ৫০ পয়েন্ট বেড়েছে। গতকাল ডিএসইতে টাকার অঙ্কে মোট লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৬৬৮  কোটি ৩৮ লাখ টাকা আর সিএসইতে মোট শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ১০০ কোটি ২ লক্ষ টাকা। তবে হঠাৎ কিছুদিন ধরে এভাবে লেনদেন সূচক বাড়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, বর্তমানে ত্রেুতারা অল্প মুনাফায় শেয়ার বিক্রি করে আবার নতুন শেয়ার কিনছে। এতে করে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে শেয়ার হাতবদল হচ্ছে। এ কারণেই লেনদেন বাড়ছে। এদিকে ১১ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ১ হাজার পয়েন্ট বেড়ে গতকাল ৫ হাজার ৬০২ পয়েন্টে উন্নীত হয়, যা ২০১৩ সালে সূচকটি চালু হওয়ার পর সর্বোচ্চ। গতকাল কয়েকটি ব্রোকারেস হাউসে সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ব্রোকারেস হাউসে চেয়ারগুলো ফাঁকা নেই। সবাই শেয়ার কেনা-বেচায় ব্যস্ত। দেখা গেছে, গত ২ মাসে ৫২টি কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বেড়েছে। তবে এসব কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোনো কারণ নেই বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্তে উঠে এসেছে। অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধি পাওয়া ৫২ কোম্পানির মধ্যে ১৮টিই ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি। এছাড়া ৮ কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি নিয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ একাধিকবার তথ্য প্রকাশ করেছে। অপরদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ৭ কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে তদন্তে নেমেছে বলে জানিয়েছেন বিএসইসি মুখপাত্র মোঃ সাইফুর রহমান। এদিকে বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ডিএসই’র ব্যবহার করছে শক্তিশালী সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম।  
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, শেয়ারবাজারে  লেনদেন ও সূচক বাড়লেও এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে যায়নি। অনেক কোম্পানির শেয়ার দাম স্বাভাবিক আছে। এ কারণে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের ভালো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে বর্তমান অবস্থায় সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দুর্বল কোম্পানির শেয়ার। তিনি আরো বলেন, আগে থেকেই যাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আছে তাদের কোনো সমস্যা হবে না। তবে নতুন করে এখন যারা না বুঝেই বাজারে আসছে, তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সাইফুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, শেয়ারবাজার অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে সমন্বয় করছে। এখন বাজারে স্বাভাবিক অবস্থানে রয়েছে। তবে যারা ঋণ করে বাজারে বিনিয়োগ করবে তাদের জন্য সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তিনি আরো বলেন, যে সব কোম্পানির শেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ, সে কোম্পানির বিষয়ে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগকারীদের বুঝানোর চেষ্টা করি। তারপরও যদি কেউ ওই কোম্পানি শেয়ার কেনে তাহলে সেই দায় তাকেই নিতে হবে। পুঁজিবাজার একটি টেকনিক্যাল জায়গা। এখানে বিনিয়োগকারীরা যত বেশি জানবেন, তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত তত  বেশি ভালো হবে।  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেছেন, বর্তমানে বাজারে  যে অবস্থা, এটা আরো দেড়-দুই বছর আগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দেরিতে হলেও হয়েছে, তাই আমি মনে করি বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি।  আরো গতিশীল হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামসুল ইসলাম। তিনি শেয়ারবাজারে গত তিনি বছর ধরে বিনিয়োগ করে আসছেন। জানান, বর্তমান শেয়ার দাম ও  সূচক নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন। মাঝে মাঝেই কোম্পানি সবকিছু দেখে শেয়ার কেনে, আবার অল্প লাভে ছেড়ে দেয়। এতে করে  লোকসান হচ্ছে না বলে তিনি জানান।
গত মাস থেকে মামুন নামের এক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে এসেছেন। তার বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। তিনি বলেন, হঠাৎ শেয়ারবাজার জেগে ওঠার কারণেই একটি কোম্পাটির শেয়ার কিনেছি। দরও বাড়ছে, তবে ভয় হচ্ছে যদি আবার আগের মতো বাজারে ধস নামে।  
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বা পাচ্ছে তাতে ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাজারে বিনিয়োগের আগে কোম্পানির মৌলভিত্তি দেখেই বিনিয়োগ করতে হবে। ধার-দেনা করে, পরিবারের মানুষের গয়না বেচে, বাড়ির গরু বেচে বিনিয়োগের দরকার নেই। কোম্পানি সম্পর্কে জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, যদি পুঁজিবাজারে আইন-আনুন সবকিছু সঠিকভাবে পালন হয় তাহলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপির ৫০ শতাংশ অবদান রাখবে পুঁজিবাজার। আমাদের দেশে অর্থনীতিতে বর্তমানে পুঁজিবাজারের অবদান মাত্র ১৯ শতাংশ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অর্থনীতিতে সেদেশের পুঁজিবাজারের অবদান ৭০ শতাংশ।  
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আমাদের সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা। আমরা সেটা করেছি। ডিমিউচ্যুয়ালাইজেনসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। বাজারে আস্থা ফিরে এসেছে। গত কয়েক মাস ধরে বাজারে ভালো অবস্থা বিরাজ করছে। এটা যাতে আরও বেগবান হয়, সেই প্রচেষ্টা নেয়া হবে। এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি, ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের এখানে একটা শক্তিশালী পুঁজিবাজার সৃষ্টি হবে, যেখান থেকে আমরা বিভিন্ন বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারব। সেটা হতে মাত্র তিন বছর বাকি। এই তিন বছরের মধ্যেই হবে বলে আমার বিশ্বাস। ফলে পুঁজিবাজারে ২০২০ সালের মধ্যে ‘নতুন দিগন্ত’ উন্মোচিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি পুঁজিবাজারের বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন, কোনো তথ্য না নিয়ে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারী সব হারিয়ে ফেলে। এর জন্য সরকার ও অর্থমন্ত্রীকে  দোষারোপ করা হয়। কিন্তু গুজবে বিনিয়োগ করে লোকসান করলে দায়ভাব নিজের। তিনি আরো বলেন, আমরা হুজুগে মাতাল। সব হারিয়ে হায় হায় করি। সেটা যাতে না হয়, তার জন্য সঠিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা দরকার।



 

Show all comments
  • রবিউল ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:২৯ এএম says : 0
    শেয়ারবাজারে সঞ্চিত পুঁজির সর্বোচ্চ অর্ধেক বিনিয়োগের করা উচিত। কোনভাবে এর বেশি নয়।
    Total Reply(0) Reply
  • শাহে আলম ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ৩:০২ পিএম says : 0
    শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে না জেনে এখানে বিনিয়োগ করা ঠিক না।
    Total Reply(0) Reply
  • তাজরিয়া ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ৩:০৪ পিএম says : 0
    বাজারে মাঝে মাঝে মূল্য সংশোধন হওয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • রুস্তুম আলী ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ৩:০৫ পিএম says : 0
    শেয়ার বাজারে দুষ্কৃতিকারীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • মাহফুজ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ৩:০৭ পিএম says : 0
    সঠিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা দরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • Laboni ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ৩:৪০ পিএম says : 0
    Many many thanks to the reporter.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেয়ারবাজার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ