সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ক্ষতি ১ দশমিক ৬ শতাংশ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল
ফ জ লে রা ব্বী দ্বী ন : কদিন ধরে সংবাদপত্রের পাতায় কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত খবর বের হচ্ছে। এইতো মাসখানেক আগেই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্য নিয়ে কি এক গ-গোল শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের এই উল্লাস আবার চুপসে যাওয়া মুখের ছবি ক্রমাগত পত্রিকার দুই তিন পাতা দখল করে নিয়েছিল। এখন অবশ্য কিছুটা কমেছে কিন্তু সেই গবেষণার রেশ কিন্তু চলছে এখনও। ‘প্লানেট নাইন’ সূর্যের পরিবারে সম্ভাব্য নতুন সদস্য। সেই বিষয়ে সব ধরনের সন্দেহ দূর হয়েছে তাও কিছুদিন আগে। কিন্তু এইসমস্ত আরও নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কারের চিন্তা বাদ দিয়ে গবেষকরা যখন মঙ্গলে থাকা খাওয়ার কথা একদম কনফার্ম করে ফেলে তখন কি আর দুনিয়ার স্বপ্নচারী মানুষ ঠিক থাকতে পারে? লাল বর্ণের আলোর মত দেখতে মঙ্গল গ্রহটিতে যে করেই হোক এক রাতের জন্য হলেও লেপ মোড়ে থাকার স্বপ্নটা ঘুমের ভেতরেই দেখে ফেলেছিল কেউ কেউ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনিত কি কারণে যেন পাতলা বায়ুম-লের দোহায় দিয়ে বিজ্ঞানীরা আবার থমকে দাঁড়ালেন। পরবর্তী দিনেই পত্রিকার প্রথম পাতায় একেবারে বড় বড় অক্ষরে হেডলাইনে চলে এল, ‘কনফার্ম টিকিট হাতে না ধরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত আপনারা (মানে সাধু মশাই বিজ্ঞানীরা) স্বপ্ন দেখাতে যাবেন না। নইলে কিন্তু পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হবে বিশ্ববাসী।’
কিন্তু আজ পত্রিকায় নতুন আরেকটা খবর। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম আমাদের এই গ্রামকে নিয়ে লেখা হয়েছে। হকচকিয়ে উঠে পুরু কলামটা পড়া শুরু করলাম। আজ থেকে প্রায় পাচশ বছর আগে এইখানে নাকি বিশাল বড় এক দুর্গ ছিল। কিন্তু তখনতো এসব জায়গায় জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কালক্রমে সেইসব জঙ্গল, দুর্গ মুছে গিয়ে এখন শুধু ইতিহাসের সাহ্মী। কিন্তু কিছুটা হলেও এর অস্তিত্ব তো আছেই। এই যেমন বড় বড় পাথরের স্তূপ। তবে এখানে বড় কোন পাথরের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই নিয়ে ইতিহাসবিদেরা কথা তুলেছে এতদিনে। পত্রিকার খবরটা পড়ে কেমন যেন স্বস্তির চেয়ে অস্বস্থিই কাজ করতে লাগল বেশি। দেশের অত সব বড় বড় জাগয়া থাকতে প্রতœতাত্ত্বিকদের কেন মনে হল যে এই গ্রামেই রয়েছে কাক্সিক্ষত সেই দুর্গ। কি আছে সেখানে? আর সেটা খুঁজেই বা কি করবে তারা?
রাতের ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বাজছে। চোখে কোন ঘুম নেই। একজন গবেষণাপ্রিয় আর বইপাগল মানুষ আমি। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য সব ধরনের ভয়ভীতিকে তোয়াক্কা করতে রাজি আছি। পশ্চিম পার্শ্বের বন্ধ জানালাটা আস্তে করে খোলে দিতেই কোথা থেকে যেন ঠা-া এক শীতল হাওয়া প্রাণটাকে একেবারে জুড়িয়ে দিয়ে গেল। দূরের কোথাও শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক কানে ভেসে আড়ছে প্রতিনিয়ত। জোনাকির মিটিমিটি আলোর দৃশ্য দেখতে গিয়ে হঠাৎ সামান্য দূরের একটা আজব দৃশ্য চোখে পড়ল। আমবাগানের ঠিক উল্টোপাশটা থেকে কেমন যেন এক ধরনের ঝাপসা আলো ভেসে আড়ছে চোখে। দরজা খুলে অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বুকের ভেতর সামান্য ভয় কাজ করছে। তবুও পিছপা হতে রাজি নই। নারিকেল গাছের পাশ কেটে যাওয়ার সময় উপর থেকে কি যেন একটা ধপাৎ করে পড়ল একেবারে সামনে। বুকটা ধুক করে উঠল। টর্চ লাইটটা সেইদিকে তাক করে দেখি একটা ঝুনো নারিকেল। কপালের ঘামটা আস্তে করে হাত দিয়ে মুছে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আলোটার প্রায় কাছাকাছি। আমবাগানের বিপরীত পার্শে পুরনো একটা পরিত্যক্ত পুকুর। তাতে আমার বাপ দাদার আমল থেকেই কোন প্রকার পানি নেই। কেন বা কি কারণে পুকুরটা খনন করা হয়েছিল তা কেউ জানে না। পরবর্তী প্রজন্মের মাথায়ও নতুন কিছু চিন্তা বা পরিকল্পনা আসেনি পুকুরটা নিয়ে নতুন কিছু একটা করার। মাছের চাষও তো করা যায়। এ নিয়ে বাবার সাথে কম কথা কাটাকাটি করিনি। কিন্তু লাভ হয়নি। নোংরা পুকুরটা দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু সেই নোংরা পুকুরটা থেকেই যে ঝাপসা ঘোলাটে ঘোলাটে আলো বের হচ্ছে সেই ব্যাপারে হানড্রেড পারসেন্ট কনফার্ম। চোখ দুটা আরও বিস্ময়কর হয়ে উঠল যখন পুকুরটার মাঝখানে নেমে পড়লাম। এ যেন রহস্যময় কোন এক মায়াজালের ফাঁদ। ক্রমাগত আমাকে সেইদিকে যাওয়ার জন্য টানছে। আর আমি সেই টানে পাগলের মত কাছে ছুটে যাচ্ছি। পায়ের নিচে মাটি আছে কিনা জানি না। থরথর করে কাঁপছে আমার শরীর। কিছু ঝনঝনানি শব্দ নতুন করে শুরু হল। পায়ের নিচে বোধ হয় শুঁকনো মচমচে পাতার স্তূপ। লাইটটা সেইদিকে তাক করার কোন ইচ্ছে প্রকাশ করলাম না। আলোটার উৎপত্তি বোধ হয় এখানেই। বা হাতটা দিয়ে আস্তে করে উপরের কিছু গাছের পাতা সরাতেই ঠা-া কিছু অনুভব করতে পারলাম। আর আমার সারা গা শিরশির করে কাটা দিয়ে উঠল। এবার লাইটের আলোটা ভালোভাবে জ্বালিয়ে দেখি মস্ত একটা পাথর। এবং আলোটা সেই পাথর থেকেই আড়ছে। কিছু নিশ্চিৎ হলেও মনের ভিতর খটকা লেগেই থাকল। এই পাথরের নিচে কি আছে সেটা দেখতে পারলেই রহস্যের কিছুটা উন্মোচন হবে নচেৎ নয়।
পরের দিন। স্কুল থেকে ফিরে এসেই দাদুর কাছে ছুটে গেলাম। জানতে চাওয়ার প্রবল ইচ্ছাগুলো দাদুর কাছে পেশ করতেই দাদু হকচকিয়ে উঠল। চোখ দুটো বড় বড়ো করে বলল, ‘উপরওয়ালার কাছে হাজার শুকর যে তুই বেঁচে ফিরেছিস্। আর ভুল করেও ঐ পরিত্যক্ত পুকুরটার কাছে যাস্ না। ওটাকে মৃত্যপুকুরও বলা যেতে পারে।’
‘মানে? কিন্তু আমিতো সেই জায়গাটাকে গত মধ্যরাতে পরখ করে দেখেছি। কই, কিছুই তো হল না আমার। শুধু বিশালাকার একটা পাথর দেখতে পেলাম। আর তার নিচ থেকে কেমন যেন ঝাপসা এক ধরনের আলো বের হচ্ছিল। চেষ্টা করলাম পাথরটাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরাতে কিন্তু পারলাম না তো!’
‘তুই ওটা পারবি না। শুধু তুই কেন, কারও একার পক্ষে ঐ পাথরটা সরানো সম্ভব নয়। তাহলে একটা গল্প শুন্। আমি যখন তোর মত কিশোর বয়সে ছিলাম তখন আমিও রাত-বিরাতে নদীর পাড়, জঙ্গল বা বাগানের পাশে বসে বসে রাতের আকাশ দেখতাম। তখন তো দুনিয়াটা অন্ধকারাচ্ছন্নই ছিল। আমি ছিলাম সবার থেকে একটু আলাদা। একটু স্বপ্নপাগল, ইচ্ছেপাগল। আজকের এই জায়গাটা তখন গাছগাছালি দিয়ে পূর্ণ ছিল। এক কথায় আশপাশের এইসব জাগয়াগুলো পুরুটাই একদম জঙ্গল ছিল। আমি একবার সন্ধ্যার পর আর বাড়ি ফিরিনি। আমার বন্ধুর সাথে খালের পাড়ে বসে বসে গল্প করছিলাম। রাত কোনদিক দিয়ে বাড়ছিল কিছুই টের পাইনি। আনুমানিক বলতে পারি মধ্যরাত হতে বোধ বেশিক্ষণ আর বাদ ছিল না। এমন সময় এক দল লোককে দেখতে পাই। হারিকেন জ্বালিয়ে জঙ্গলের পাশ দিয়ে চুপচাপ এগিয়ে আড়ছে এদিকেই। আমরা দুই বন্ধু মিলে লুকিয়ে পড়ি নারিকেলের ঝোপে। সেই এক দল লোক আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত পুকুরটার ভিতরে নেমে ঠিক তোর মতই ময়লা-আবর্জনাগুলো সরিয়েছিল। তারপর বিশাল পাথরটা কোনমতেই সরাতে পারছিল না। ওরা কিভাবে এই রহস্যময় জায়গাটার কথা জেনেছিল কিছু বলতে পারব না। ওখানে দুইতিনটা সুপারি গাছ ঘেরাও ছিল বলে ধারালো ধারালো খন্তি দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলেছিল গাছগুলা। তবুও পাথরটা সরাতে পারছিল না কোনভাবেই। অবশেষে আরও কয়েকটা লোক এসে জমা হল কোথা থেকে যেন। তারপর সবাই মিলে যেই পাথরটা হালকা উঁচু করেছে অমনি নিচ থেকে দুইটা বড় বড় গোখরো সাপ ফনা তুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুইজন ছাড়া আর কেউই বাঁচতে পারেনি সেদিন। স্বচক্ষে আমি আর আমার বন্ধু দেখেছি এই দৃশ্যটা। তবে যারা বেঁচে গেছে তাদের মুখ থেকে শুনা যায় ওই পাথরটার নিচে নাকি গর্ত রয়েছে। আর তাতে মনিমুক্তার অভাব নেই। কিন্তু পরবর্তীতে আর কেউই সাহস করে সেই ধনরতœ পাওয়ার আশায় জীবন বাজি রাখতে যায়নি।’
দাদুর মুখে গল্প শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এটা একটা বাস্তব ঘটনা। তবে আমার ভাগ্যটা বোধ হয় ভালোই ছিল যে পাথরটা উঁচু করার চেষ্টা চালিয়েও পারিনি। এ খবরটা ঝড়ের গতিতে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু রাফিদকে জানিয়ে দিলাম। ঠিক করলাম দুইজন মিলে কিছু একটা করার। যেকরেই হোক ওই পাথরটার আসল রহস্য দুইজনেই উন্মোচন করব। এত সহজেই প্রতœতাত্ত্বিকদের খবর দিচ্ছি না। এক ধরনের লোভ কাজ করছিল। সন্ধ্যার আগেই আগন্তুক বন্ধু আমার বাড়ি এসে হাজির। বিভিন্ন ধরনের প্ল্যান-টø্যান মগজ ধোলাই করে নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম। ঠিক মধ্যরাতেই আমাদের আসল কাজ শুরু হবে।
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে। লাল টকটকে চোখ দুটোতে কোন ঘুম নেই। বুকের ধুকধুকানি ঘুমোতে দিচ্ছে না। হঠাৎ বিছানার পাশ ফিরে দেখি রাফিদ নেই। টেবিলের উপর রাখা টর্চ লাইটটাও নেই। সবকিছু কেমন যেন গ-গোল পাকিয়ে ফেলছি। তাহলে কি রাফিদ আমাকে একা রেখেই পরিত্যক্ত ঐ পুকুরটার দিকে ছুটেছে। এত লোভ ওর! নির্ঘাদ কিছু একটা ঘটতে চলেছে আজ। কেন যে ওকে এতকিছু বলতে গেলাম! শহরে গিয়ে একবার সাংবাদিকদের খবর দিলেই তো সবকিছুর সমাধান হয়ে যেত। যাক্ এখন আর ওইসব ভেবে কোন লাভ নেই। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কোনমতে রাফিদকে সেই রহস্যময় পাথরটার কাছ থেকে ফিরাতে পারলেই বাঁচি। হাতের কাছে হারিকেনটা পেয়ে ভালোই হল। চুপিচুপি রান্নাঘর থেকে হারিকেনে আগুন ধরিয়ে ছুটে গেলাম কাক্সিক্ষত সেই জায়গায়। গতরাতের মতই সবকিছু বিভীষিকাময় ও ভয়ংকর। ঝিঁঝিঁ পোকার ক্লান্তিকর ডাকে কপাল দিয়ে ঘাম ঝরা শুরু করল। আস্তে আস্তে আরও সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে। নারিকেল গাছগুলোর পাশ কেটে আমবাগানের বিপরীত পার্শ্বে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই পাথরটার কাছে কি যেন একটা দেখতে পেলাম। হারিকেনের আলোটা আরও একটু ঘন করে দিতেই সবকিছু আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। পাথরটার কাছে প্রায় তিনটা গোখরো সাপ ফনা ধরে ত্রিভুজাকৃতির মত হয়ে ফসফস করছে। ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই মাটিতে কাকে যেন দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে একটা মানুষের লাশ। নিঃশব্দে হালকা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি আমার বন্ধু রাফিদ। বিষধর সেই সাপগুলা তার সারা শরীরে বিষ ঢুকিয়ে থেতলে ফেলেছে। তারপর আর কিছু দেখতে পারি না। হাতের হারিকেনটা হাত থেকে ধপাস করে পড়ে চিমনি টা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর আমি অচেতন অবস্থায় সারা রাত পড়ে থাকি ওখানেই।
সকাল হলে চোখ খুলে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। আর মাথায় কে যেন পানি ঢালছে। ভীষণ রকমের জ্বরে সারা শরীর কাঁপছে আর কাঁপছে। কান্নাকাটির আওয়াজও বেশ পাওয়া যায়। বাড়ি ভর্তি পুলিশ এসে হাজির। তারা নানান ধরনের তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত। সারা গাঁয়ের মানুষ এসে জড়ো হয়েছে আমাদের বাড়ির উঠোনে। ততক্ষণে সেইসমস্ত ইতিহাসবিদরাও এসে হাজির হয়ে গেছে। তাদের চোখে মুখে স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। তারা তাদের ধারণাকে সাক্সেস করতে পেরেছে। সারা দেশজুড়ে এই গ্রামের খবর বাতাসের বেগে দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
কিছুদিনের মধ্যেই আমার অসুস্থ শরীর সুস্থ হতে থাকে। ভালো একটা দিন দেখে দাদু আমায় দূরের এক জেলা সিরাজগঞ্জে পাঠিয়ে দেয়। তারপর সেখানে থেকেই আমার পড়ালেখার নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। আর কখনও অতীতের দিকে ফিরে তাকাইনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।