Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌঁছেছে

| প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আলোচনায় প্রাধান্য পাবে রোহিঙ্গা ইস্যু
কূটনৈতিক সংবাদদাতা : বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের (বার্মা) আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের রোহিঙ্গা নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়া ও সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে তিনদিনের সফরে ঢাকা পৌঁছেছেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী উ কিয়াও থিন।
পাশাপাশি তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়েও আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক মঞ্জুরুল ইসলাম খাঁন ও অন্যান্যরা। স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র বিশেষ দূত হিসেবে তিনদিনের সফরে ঢাকায় আসা কিয়াও এর সঙ্গে রয়েছেন মিয়ানমার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
সফরকালে আজ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও দুপুরে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে মিয়ানমারের কূটনীতিক প্রতিনিধি দলের পৃথক সাক্ষাৎ-বৈঠক হবে।  মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এ সফরে বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গা শারণার্থী ও অনিবন্ধিত সব মিয়ানমার নাগরিককে ফিরিয়ে নেয়ার দাবিটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলবে ঢাকা।
জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রবেশের সংখ্যা সম্প্রতি তীব্র আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র গত সপ্তাহেই ২২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে- যার ফলে রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সহিংসতায় বাংলাদেশে মোট রোহিঙ্গা প্রবেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজারে।
বিবিসি জানায়, বার্মিজ সামরিকবাহিনী সেখানে এখনো নিয়মিতভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বার্মিজ কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোকে রাখাইন রাজ্যের স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। যার ফলে যে প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গা এর আগে নিয়মিত ত্রাণ পেত, তাদেরকে এখন কোনরকম সাহায্য দেয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে মিয়ানমারের বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত, ইয়াংহি লি মিয়ানমারে এসে পৌঁছেছেন। নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য তিনি সেখানে ১২ দিন অবস্থান করবেন।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, এদের ২০১৭ সালের মধ্যেই ফিরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মিয়ানমার সরকারের। নেপিদো’র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক কিয়াউ জায়া রয়টার্সকে বলেন, আমাদের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ২ হাজার ৪১৫ জন মিয়ানমারের নাগরিক আছে। তাদের ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। ২০১৭ সালের মধ্যেই তাদের ফিরিয়ে নেয়া পরিকল্পনা করছি আমরা। ঢাকার পক্ষ থেকে তিন লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (অনিবন্ধিত) বাংলাদেশে রয়েছে বলে বরাবরই দাবি করা হয়। রয়টার্সের তরফে এ নিয়ে মিয়ানমারের ওই কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এ নিয়ে তার ‘কোনো ধারণা’ নেই বলে মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এসেছে মূলত আমাদের অবস্থান জানতে। সেই সঙ্গে তিনি তার দেশের অবস্থান তুলে ধরবেন। বর্তমানে সেখানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সংখ্যা মুখ্য নয়, মিয়ানমার নাগরিকদের স্রোত যে থামানো যাচ্ছে না, তারা যে প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে, সীমান্ত এলাকায় মানবিক সংকট যে দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে- সেটাই দূতের কাছে তুলে ধরবে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ যে আন্তরিক এবং এ জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যেকোনো ধরনের আলোচনায় যে আগ্রহ রয়েছে সেটিও পুনর্ব্যক্ত করবে ঢাকা।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৯২ সালে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাইকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তখন দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে মিয়ানমার স্বীকার করে নিয়েছিল রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আইনগত নাগরিক। গত তিন দশকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এবং তারও আগে থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আগেই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে বসবাস করছে। গত অক্টোবর মাসে নতুন করে মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনীর হামলা শুরু হলে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
১৯৭৮, ১৯৯২ এবং ২০১২ সালে যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনী পুরনো কৌশল পাল্টে বর্তমানে নতুনভাবে তাদের ওপর নির্যাতন করছে। বর্তমানে তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে এবং এর মাত্রা এত বেশি যে, রোহিঙ্গারা নির্যাতন সইতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
উল্লেখ্য, আগামী ১৯ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় ওআইসি-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আছে রোহিঙ্গা বিষয়ে। এ কারণেই ওই বৈঠকের আগেই বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে চায় মিয়ানমার।
এদিকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। জাতিসংঘের নবনিযুক্ত মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসকে লেখা এক চিঠিতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ আরাকানে চলমান সহিংসতা, রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার তীব্র নিন্দা জানান। চিঠিতে তিনি রোহিঙ্গাদের দুর্দশাকে বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণ উল্লেখ করে এটি লাঘবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানান। গত শুক্রবার লেখা ওই চিঠিতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাতিগত মুসলিম সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র তাদের মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত নয়, তারা একটি রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। তারা একটি সরকার পাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত, যে সরকার তাদেরকে রক্ষা করার কথা।
এছাড়া সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান গত সোমবার দেশটির সংসদে দেয়া বক্তৃতায় রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দেখার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়ে মিয়ানমারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপকে উৎসাহিত করেছেন তিনি।
সূত্র জানায়, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সু চি মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তিনি গত তিনমাসে অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে একবারের জন্যও সময় দেননি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি হস্তান্তরের সময়েও তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে সময় দেননি। তবে ১৯ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় ওআইসির বৈঠক এবং আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই এখন কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্ট সর্বসম্মত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। মিয়ামারের প্রতিবেশী এবং আসিয়ানের সদস্য মালয়েশিয়া প্রকাশ্যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য দায়ী করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ