হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : আমাদের বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে, এরকম বলছেন অনেকেই। তারা বলছেন টিভি, ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন আমাদের বই পড়ার অভ্যাস থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে চলেছে। সত্যিই কি তাই? কথাটি অনেকাংশেই সত্যি। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখতে পাই সেখানে মানুষের যাতায়াত অনেকটাই কমে গেছে। সকলের একটাই কথা, বই পড়ার সময় নেই। সময়ের অভাব আমাদের কাছে একথা স্বীকার করছি। জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয় এ কথাও সত্য। বাকি সময়টা? বাকি সময়টা আমরা টিভির সামনে বসি কিংবা যাদের ইন্টারনেট সংযোগ আছে তারা সেখানে বসে সময় কাটাই। সময়ের অভাব ঠিক নয়, আমাদের স্বভাবটাই ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। আমরা সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার পর সন্ধ্যার দিকে টিভির সামনে বসে জীবনের সাথে যার কোনো নিবিড় যোগাযোগ নেই সেইসব অবাস্তব কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো দেখতে থাকি। সেই সিরিয়ালগুলোর সংলাপ শুনলে হাসি পায়। জীবন থেকে উঠে আসা কোনো গভীর অনুভূতির ছোঁয়া নেই সিরিয়ালগুলোতে। তারপরে আছে ‘রিয়েলিটি শো’। এ বিষয়ে বেশি কথা না বলা বোধ হয় ভালো। বিভিন্ন আলাপচারিতায় এই ‘রিয়েলিটি শো’-এর কথা শুনে বোঝা যায় এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ওই লিখতে লিখতে যেমন ‘লাভ’ হয়ে যায়, তেমনি দেখতে দেখতে ভালো লেগে যায় এই আর কি! আর এই ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবী এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। এর সঠিক ব্যবহার আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করছে, জ্ঞানের পরিধির বিস্তার ঘটাচ্ছে একথা ঠিক। কিন্তু এর সদ্ব্যবহার কি আমরা করছি? এই ইন্টারনেটের সাহায্যেই তো এখন নানারকমের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে।
যে সময় আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেখানে আমাদের অনেকেরই মনে হয়, বই পড়ে কী লাভ? সব কিছুর মধ্যেই এখন আমরা লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে শিখেছি। নির্ভেজাল আনন্দের জন্য আজ আমরা কোনো বই পড়তে চাই না। কাজেই বই যদি পড়তেই হয় তাহলে কাজের বই পড়া ভালো একরকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। কিছু মানুষ আছেন যারা পেশাগত কারণেই বই পড়তে বাধ্য হন। এর বাইরে একটা বৃহৎ শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা নির্ভেজাল আনন্দ লাভের জন্য, অজানাকে জানার জন্য, বাড়িতে বসেই বিভিন্ন চরিত্রের মানুষদের সঙ্গলাভ করার জন্য, লেখকের অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করার জন্য, দৈনন্দিন জীবনের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং সর্বোপরি এই মূঢ়তা থেকে মুক্তিলাভের একটা প্রবল আকাক্সক্ষা থেকেই তারা বই পড়েন। তারা কোনো পার্থিব লাভক্ষতির হিসাবের ধার ধারেন না। হাজার কাজের ভিড়েও তাই তারা ঠিক সময় বের করে বই হাতে তুলে নেন। তাদের কাছে বই এক অমূল্য সম্পদ। এই বৃহৎ শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই ইদানীং বই পড়ার প্রবণতা কমে আসছে বলেই শঙ্কা হচ্ছেÑ ধীরে ধীরে পৃথিবীরটা ইট-কাঠের জঙ্গলে না পরিণত হয়।
আসলে ছোটবেলা থেকে এক সময় মাস্টার সাহেবের উৎসাহে কিংবা বাড়িতে মা-বাবা বা কোনো আপনজনের উৎসাহে এই সু-অভ্যাস গড়ে উঠত। এখন সেই মাস্টার সাহেবরা নেই আর বাড়িতে তো এখন এমন একটা পরিবেশ যে সকলে বলছেন ওই সব গল্পের বই রেখে দিয়ে পড়ার বই পড়ো, ফালতু সময় নষ্ট করো না। আর ছোটরাও সিলেবাসের চাপে পড়ে ঘাড় সোজা করতে পারছে না, খেলাধুলাও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই ছোটবেলাতেই এখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা গড়ে তোলার পরিবর্তে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই কথা অধিকাংশ বাড়ির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বাবা-মা বইমেলাতে স্কুল-পড়ুয়াদের নিয়ে গেলে সব সময়ই নির্দেশ দেন কাজের বই কেনার জন্য। এই প্রবণতা থেকে উঠে আসছে এক ধরনের বই না-পড়া নাগরিক। বই পড়া বলতে আমি এখানে নির্ভেজাল আনন্দের জন্য বই পড়ার কথা বলছি। ছোটবেলা থেকে বই পড়তে পড়তেই এক সময় বই-এর প্রতি যে প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হয় সেটা কিন্তু আজকের দিনে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
যিনি বই পড়েন তিনি ঠিক সময় বের করে বই পড়েন। যারা বলছেন সময় পাচ্ছি না তারা ঠিক বলছেন না। যিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখেন, গভীর রাত পর্যন্ত নেট সার্চ করেন তিনি সময় পান না বললে কেউ কি বিশ্বাস করবেন? সত্যি কথা হল রুচির অভাব, মননের অভাব এবং শিক্ষার অভাব। টিভি সিরিয়াল দেখবেন না বই পড়বেন এটা তাকেই ঠিক করতে হবে। চিন্তাশীল বিখ্যাত মানুষদের জীবন কথা পড়তে গিয়ে আমরা জানতে পারি তাদের বই পড়ার প্রবল আগ্রহের কথা। তাদের পড়াশুনার ব্যাপ্তির কথা জেনে ‘বড় বিস্ময় লাগে’। বই-এর কোনো বিকল্প নেই। একসময় বিয়ে, জন্মদিনে, উপনয়নে বই উপহার দেওয়া হত। এখন সেটা করতে গেলে অনেকেই হাসবে। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রের কথা বাদ দিলে এই ধারা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। আমরা নিজে থেকেই বই-এর সংশ্রব ত্যাগ করছি। বেঁচে থাকার জন্য অর্থের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, এ কথা স্বীকার করে নিয়েই বলতে হচ্ছে বিদ্যাচর্চার চেয়ে অর্থচর্চাই এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। ভোগবাদী জীবনের হাতছানি মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই বই পড়ার জন্য কেউ সময় দিতে চাইছেন না। এ যেন সেই ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’ সোনার হরিণের পেছনেই আমরা ক্রমাগত ছুটে চলছি। আমাদের আচার-আচরণই সে কথা জানান দিচ্ছে। বই না পড়ার ফলে অসংস্কৃত, অমার্জিত মানুষজনের সংখ্যা বাড়ছে। সুভদ্র, রুচিশীল, সংবেদনশীল, হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। মানুষের জীবনের গভীরে আত্মসংকট দেখা দিয়েছে। সংবেদনশীল মানুষরাই সমাজের কথা, দেশের কথা, পরিবেশের কথা খুব গুরুত্ব সহকারে ভাবেন এবং প্রয়োজনে মানুষের ভালো করার জন্য সর্বস্ব পণ করতে পিছপা হন না। এই দুঃসময়ে তাদেরই বেশি প্রয়োজন। বই না পড়লে তো আমরা কূপম-ূক হয়ে যাব। এই মানবজমিন পতিত থেকে যাবে। অনেকদিন আগেই বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রেথট বলেছেনÑ ‘ভুখা মানুষ হাতে নাও বই, এই তোমার হাতিয়ার।’ বই যদি শক্তিশালী না-ই হবে তাহলে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে এত বই পোড়ানোর ঘটনা কেন ঘটেছে? সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটির কথা ভাবুন সেখানে পাঠশালার প-িতমশাইয়ের বাড়ি থেকে সব বই বের করে হীরক রাজার অনুচরেরা পুড়িয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে বই পোড়ানোর বহু ঘটনার কথা আমাদের জানা।
বই পড়ে আমরা অনেক অজানা রহস্যের সমাধান করতে পারি। যারা নিয়মিত বই পড়েন তারা একথা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, কোনো একটা বইতে কোনো বিষয় পড়ে বুঝতে পারলেন না অথবা হয়তো কোনো শব্দের প্রকৃত অর্থও হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন না কিন্তু পরে অন্য বই পড়তে পড়তে আপনি সেসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেয়ে যান। তখন নিশ্চয়ই কোনো কিছু আবিষ্কারের মতো আনন্দ উপভোগ করেন। আশা করি পাঠক মাত্রেই এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। বই পড়ার নিয়মিত অভ্যাস থাকলে স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকে, মন প্রফুল্ল থাকে। এই অভ্যাস আমাদের মানসিক অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে এবং মনসংযোগ বাড়িয়ে তোলে। আরো একটা আশ্চর্যের কথা বই পড়তে পড়তেই আমরা কত বিচিত্র, জটিল এবং মহানুভব ও সর্বত্যাগী মানুষের সন্ধান পাই। বই মানুষকে যেমন কর্ম পটু রাখে তেমনি অনেক ভাবনাকেও সে সক্ষম করে তোলে। এমন কতগুলো বই আছে যা পড়ে মানুষ সমস্ত পৃথিবীকে পরিবর্তনের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হতে পারেন। জীবনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে, অভ্যাসের বেড়া ভাঙতে হলে এবং সর্বোপরি সংস্কারমুক্ত হতে হলে বই আপনাকে পড়তেই হবে। বই আমাদের মনের দরজা খুলে দেয়। বই সম্পর্কে ওমর খৈয়াম বলেছেন- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বই অনন্তযৌবনা- যদি তেমন বই হয়।’ কাজেই আমাদের বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতেই হবে কেননা শেষ পর্যন্ত বই-ই আমাদের প্রকৃত বন্ধু।
॥ দুই ॥
‘অদ্ভূত আঁধার এক’ ক্রমাগত ঘনিয়ে উঠছে আমাদের চারপাশে। বইয়ের বদলেই-বই, জ্ঞানের বদলে তথ্য। তথ্য বিস্ফোরণের এই সময়ে তথ্যকে খাড়া করে দেওয়া হচ্ছে নলেজ’-এর সহজ বিকল্প হিসাবে। ছাপা বইতে মগ্ন হবার অভ্যাস কমছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভিতর। ইন্টারনেটে ডাউনলোড করাই-বই হয়ে দাঁড়াচ্ছে ছাপা বইয়ের সস্তা বিকল্প। প্রযুক্তি চাইছে তথ্যে তথ্যে আপনার, আমার, আমাদের ছেলেমেয়েদের মগজগুলোকে ঠেসে ভরে দিতে। বিজ্ঞান বলছে, মাত্রাতিরিক্ত তথ্যের ধাক্কায় মগজের নেটওয়ার্ক সেভাবে বাড়ছে না নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের। মগজে ফুটে উঠছে না নতুন নতুন ‘চোখ’। যে চোখ জ্ঞান বাড়ায়, যে চোখ তৈরি হয় নিয়মিত নানান বিষয়ে ছাপা বই পড়লে। পুরনো হয়ে যাচ্ছে টিভি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোন ও নেটে এ সময় কাটাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। টিনএজারদের মধ্যে চলমান টেলিফোনে ব্যাপক আসক্তি আশঙ্কা বাড়াচ্ছে মগজের নানা টিউমারের, কানে কম শোনার। বড়দের বেলায় স্মৃতিভ্রংশের রোগ অ্যালঝাইমারের, পরকিনসন্স ডিজিজের। নেটবাহিত অসভ্যতা, অশ্লীলতার প্রভাব পড়তে শুধু করেছে কমবয়সীদের আচার-আচরণে। প্রযুক্তির দাস বনে যাচ্ছে মানুষ, দ্রুতলয়ে। কমছে সামাজিকতা, বন্ধুত্ব। বাড়ছে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব। আড্ডার বদলে চ্যাট, আনন্দের বদলে যৌনতা, বই পড়া ছেড়ে স্মার্টফোন আর নেটের মৌতাত! সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি অনেক দিন আগে এখন পরিবার থেকে, সবশেষে নিজেই নিজের কাছ থেকে। বাচ্চারা তো কবেই হারিয়ে ফেলেছে শৈশব। ‘নালক’ নেই, ‘আবোলতাবোল’ নেই, নেই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। শৈশবে গল্প শোনানোর দাদী, ফুফু, বোন হারিয়ে গিয়েছেন কবে। প্রযুক্তির হাত ধরে অতিদ্রুত বড়দের জগতে ঢুকে পড়ছে শিশুমন। তৈরি হতে পারছে না, হলেও ভেঙে চুরমার হচ্ছে শৈশবের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো। বাচ্চারা চাইছে ‘আরও, আরও’। বড় হতে হতে বাড়ছে চাওয়া-পাওয়ার ফারাক। মিলিয়ে যাচ্ছে আনন্দ, বাড়ছে বিষাদ। চাইল্ডহুড আর পেরিপিউবারটাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছেলেমেয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ওদের অনেকের মধ্যে দেখা দিচ্ছে আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক আচরণ। বাড়ছে কম বয়সেই অপরাধ, খুন, জখম, ধর্ষণ, গণপ্রহারের ঘটনা।
টিনএজারদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দু’দশকে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। এর পেছনে অনেকটাই, জানাচ্ছেন ভারতের ব্যাঙ্গালুর ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ’-এর একদল বিজ্ঞানী। অন্ধকারই শেষ কথা নয়, আঁধার পেরিয়ে আলোর স্বপ্ন থাকে চিরকাল। পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেয়ালে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি, নেটের সামনে বসে চুপচাপ দেখে যাবার দিন শেষ। বাচ্চারা শেখে বড়দের থেকে, বড়দের দেখে। যে কোন ছোট পরদার দেখা বা শোনা তথ্য গভীর চাপ ফেলতে পারে না আমাদের স্মৃতির সড়কে। ‘মেমরি পাথওয়ে’কে দুরন্ত করে তুলতে পারে ছাপা তথ্যের সংকেত। বাড়াতে পারে মগজের নেটওয়ার্ক।
বই পড়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তা শুধু মানুষের মগজের নেটওয়ার্ক বাড়ায় না, বাড়ে তথ্য সংশ্লেষের ক্ষমতা। সৈয়দ মুজতবা আলির কথায় ‘বই পড়তে পড়তে মনের নিত্য ভুবন বড় হয়। ‘মুখ ঢেকে’ দেওয়া বিজ্ঞাপনের এই সময়ে, প্রযুক্তির এই রমরমার যুগেও তথ্য জ্ঞান নয়, ‘তথ্যের বাজার’ যাই বলুন। এটাই বাস্তব। তথ্য সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে, মগজ পৌঁছতে পারে বিরাট একটা ছাতে। ওই ছাতাটাই জ্ঞান। তথ্যের সংকেত যথেষ্ট তীব্র না হলে সিঁড়ি ভাঙা থেমে যায় মাঝ পথে। তথ্য তথ্যই থেকে যায়, ‘নলেজ’-এ উত্তরণ আর ঘটে না। ইলেকট্রনিক মিডিয়া অবশ্যই লক্ষ লক্ষ তথ্য জোগাতে পারে। প্রিন্টিং মিডিয়া শুধু তথ্য জোগায় না। বই পড়ে কল্পনা বাড়ে, বিস্তৃত হয় মগজের নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক যত বড় হবে, তত বাড়বে স্মৃতি, বুদ্ধি, মেধা, বিশ্লেষণের দক্ষতা, তুলনা আর বিচারের ক্ষমতা। প্রযুক্তিকে পুরোপুরি বিদায় জানানো আজ অসম্ভব, তার দারকারও নেই। ভাবুন একটু অন্যভাবে। টিভি, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট থাক। শুধু এগুলোর ব্যবহারে দরকার রাশ টানার। বিশেষ করে কম বয়সে সেলফোন আর নেট ব্যবহারে চাই কঠিন নিয়ন্ত্রণ। যে কোন বয়সে জরুরি বা দরকারি কাজ ছাড়া কেন ব্যবহার করবেন স্মার্টফোন বা নেট? একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার ব্যবহারে শুধু মগজ বিবশ হয় না, আশঙ্কা থাকে ভিডিও ব্লুজ, নেক-শোল্ডার সিনড্রোম বা আরও জটিল নানা রোগে আক্রান্ত হবার। ফিরতেই হবে ছাপা বইয়ের কাছে, বিকল্প নেই। কী ভাবছেন? স্কুল-কলেজেই তো কত বই পড়ছে আপনার ছেলেমেয়ে। হক কথা, প-িত বানানোর স্কুল-কলেজে এখন পড়তে হয় বিস্তর বই। তবে সেই বই পড়ার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় পাস করা। শুধু পাঠ্যবই পড়ে মনের ভুবন বড় হওয়া অসম্ভব। পড়ার বই থাক, তার পাশাপাশি চাই পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া। ছেলেবেলায় আমরা যেমন পড়তাম, কেউ কেউ আজও পড়ি। ভাবুন তো। ঘুমপাড়ানি ছড়া শুনতে শুনতে, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র গল্প’, ‘বুড়ো আংলা’য় ডুবে যেতে যেতে যে সোনালি শৈশব আপনাকে পৌঁছে দিয়েছে আজকের আপনাতে, তার কতটুকু পেয়ে আপনার ছেলে বা মেয়ে? ভাবুন সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’ ‘হ য ব র ল’ বা ‘পাগলা দাশু’ আপনাকে পৌঁছে দিত কোন কল্পনার রাজ্যে, আনন্দের দেশে। যৌবনে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ পড়তে পড়তে কোন জাদুতে আমরা পৌঁছে যেতাম লবটুলিয়ার অরণ্যে, জোৎস্নাভেজা অরণ্য পথে। ছেলেমেয়েকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে চাইলে অনুগ্রহ করে ইঁদুর দৌড়ে ওদের লড়িয়ে দেওয়াটা এবার থামান। ওদের হাতে একেবারে ছেলেবেলা থেকেই তুলে দিন বয়সের উপযোগী বই। উৎসাহ দিন ‘রিডিং হ্যাবিট’ গড়ে তুলতে। পড়ার বই-ই বই, বাকি সব ‘গল্পের বই’, এমন উদ্ভট ধারণা থাকলে অনুগ্রহ করে বেরিয়ে আসুন এরকম ভ্রান্তিবিলাস থেকে। একটু একটু করে পড়তে হবে আপনাকেও। আপনাকে দেখেই যে ছেলেমেয়েরা শিখবে। আপনি একটু সক্রিয় হলেই দিনে দিনে আবার ফিরে আসবে বই পড়ার সেই সাবেকি অভ্যাস। দুঃখে, আঘাতে, নিভৃতে, অবসরে, ভ্রমণে, প্রতীক্ষালয়ে, ট্রেনযাত্রায় বইয়ের মতো এমন বন্ধু আর কে আছে।
কী ভাবছেন? ই-বই তো ডাইনলোড করে নেয়া যায় বিনে পয়সায়। তাহলে আর খামোখা পয়সা খরচ করে ছাপা বই কিনতে যাবেন কেন? তাহলে শুনুন ২০১৩-র নভেম্বর মাসে বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষার ফলাফল। লিউক মিশেলের নেতৃত্বে বিলেতে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল ১৬ থেকে ২৪ বছরের পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে। দেখা গিয়েছে, ৬২ শতাংশ পড়ুয়াই পছন্দ করে ই-বইয়ের বদলে ছাপা বই পড়তে। পছন্দের কারণ অনেক। ‘বই হাতে নিয়ে কী যে সুখ।’ ‘সাজিয়ে রাখা যায় তাকে’ ‘পড়তে পড়তে আহা!’, ‘অন্যের সঙ্গে ভাগ করে পড়া যায়’, ‘যন্ত্র ছাড়াই পড়া যায়।’ আরও বহু কারণ রয়েছে ছাপা বই পড়ার। পশ্চিমের দেশগুলোতে ‘ই-বুক লাইব্রেরি’র সংখ্যা গত তিন বছরে ধীরলয়ে হলেও কমছে।
বুকে হাত রেখে বলুন, বাংলা-সাহিত্যের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কতটুকু জানে আপনার সন্তানসন্ততি? নজরুল, রোকেয়া, রবীন্দ্রনাথের অমূল্য সাহিত্য সম্পদের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায় আপনারও। অস্থির, অন্ধকার এই সময়ে টিভি, স্মার্টফোন বা নেট নয়, অন্ধকার ঘোচাতে ‘হাতে রইল পেন্সিল’, আর হাজার হাজার বই। ‘শেষের কবিতা’, ‘মাকু’, ‘পাকদন্ডী’, ‘জাগরি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘ছোটবেলা’, ‘কঙ্কাবতী’-রা থরে থরে সেজে বসে আছে আপনার আমার ঘরে, আজ-কাল-পরশুর অপু-দুর্গা-কাজলদের অপেক্ষায়। চলুন আবার ফিরে যাই বইয়ের আশ্রয়ে। বই কিনুন, পড়ুন একটু একটু করে। পড়ান ছেলেমেয়েদের। দয়া করে না পড়ে বইগুলোকে ঘর সাজানোর সামগ্রী বানাবেন না। বইয়ের দাম অনেক? ‘বই কিনে কেউ কোন দিন দেউলিয়া হয় না’, সেই কবে একথা বলে গিয়েছেন মুজতবা আলী।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।