Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ৫২৯ জেল আপিল

| প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মালেক মল্লিক : মকবর আলী। ২৭ বছর ধরে কারাবন্দি। একটি মামলায় ’৮৯ সালে ১০ বছরের কারাদ- দেন পঞ্চগড়ের সহকারী দায়রা জজ আদালত। সাজার বিরুদ্ধে জেল আপিলও করেন মকবর আলী। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ের নথি না থাকায় তার জেল আপিল উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে চার দেয়ালের ভিতরে পার করছেন বছরের পর বছর ধরে। মনে হচ্ছে কারাগারই তার বসবাসস্থল। শুধু মকবর নয়, তার মতো ৫২৯টি জেল আপিল উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এরা সবাই কোন কোন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দি। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছর থেকে শুরু করে প্রায় এক যুগের বেশি সময়েও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি রায়ের কপি, সাজার মেয়াদ শেষ হলেও কতজন কারাগারে বন্দি আছেন তা জানতে ৩৫টি কারাগারে চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। আইনজ্ঞরা বলেছেন, কারা কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে ওই কারাবন্দিদের মুক্তি মেলেনি। তারা এর দায়ভার এড়াতে পারেন না।  
সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেয়ার পর বিচারিক সেবা বৃদ্ধি ও মামলা জট কমাতে উদ্যোগ নেন, এরপর সকল আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো নথি ঘেঁটে দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে বলেন। এরপর শুরু হয় হাইকোর্টে পাঠানো জেল আপিলগুলো বিভিন্ন কারণ চিহ্নতকরণ প্রক্রিয়া। সেখানে দেখা যায়, অনেক কারাবন্দি জেল আপিল দায়েরের সময় আবেদনের সঙ্গে রায়ের নথি ছাড়াই পাঠায়। ফলে এসব পেপারবুক প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না। এজন্য এ ধরনের অসম্পন্ন জেল আপিলের তালিকা করা হয়েছে। ফলে শুনানির জন্য কোর্টে পাঠানো যায় না। সম্প্রতি জেল আপিলের রায়ের কপি চেয়ে কারাগার বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে কারাবন্দিদের মুক্তি মেলেনি। তারা এর দায়ভার এড়াতে পারেন না। কারণ, যে সব মামলার সাজা মেয়াদ শেষ তাদের তো আর আদালতের কোন আদেশের প্রয়োজন নেই। তিনি আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যে উদ্যোগ নিয়েছে এটা অবশ্যই যুগোপযোগী। এটা যুগান্তরকারী উদ্যোগ। এতে করে বিচার প্রার্থীদের অনেকেরও মুক্তি কারা জীবনের অবসান হবে। মামলাও জটও কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।  
সূত্রে জানা যায়, গরীব অসহায় দ-প্রাপ্ত কারাবন্দি যাদের উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনার সক্ষমতা নেই, আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন না, তারা সাধারণত জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে  জেল আপিল দায়ের করেন। জেলে থাকার কারণে অনেক বন্দির কাছে বিচারিক আদালতের দ-প্রাপ্ত মামলার রায়ের কপি থাকে না। ফলে আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল দায়েরের জন্য তাড়াহুড়ো করে রায়ের কপি ছাড়াই আপিল দায়ের করেন। রায়ের কপি পরে পাঠানোর কথা থাকলেও তা আর পাঠানো হয় না। এর ফলে রায়ের কপি না থাকায় ওইসব জেল আপিলের আর শুনানি হয় না। এতে বাড়ছে বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, মো.আব্দুল মতিন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলায় ’৯৯ সালে রংপুরের জেলা জজ আদালত ৩০ বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করেন। সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে জেল আপিল করেন তিনিও। তবে নিম্ন আদালতের রায়ের নথি না থাকায় সে আপিলও নিষ্পত্তি।  
আব্দুল জব্বার, যাকে একটি মামলায় রংপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত ’৮৯ সালে সাত বছরের কারাদ- দেন। পরে তিনি সাজার বিরুদ্ধে জেল আপিল করেন হাইকোর্টে। তবে আবেদনের সঙ্গে নিম্ন আদালতের রায়ের নথি না থাকায় আড়াই দশক পার হলেও আপিল নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। আর মকবর আলীকে ’৮৯ সালে ১০ বছরের কারাদ- দেন পঞ্চগড়ের সহকারী দায়রা জজ আদালত।
ঢাকা মহানগরের ৯ নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল দুলালকে ২০০৫ সালের ১১ অক্টোবর ৭ বছর সশ্রম কারাদ- দেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে আসামি দুলাল হাইকোর্টে জেল আপিল করেন। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর তার  জেল আপিলের আবেদন হাইকোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু তার আবেদনের সঙ্গে রায়ের কপি ছিল না। এমনকি পরবর্তীকালে জেল কর্তৃপক্ষ তার রায়ের কপিটি আর পাঠায়নি। ফলে ৭ বছরের দ-প্রাপ্ত আসামি দুলালের জেল আপিল ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। একইভাবে নিম্ন আদালত থেকে তিন বছরের দ-প্রাপ্ত আসামি মো. জামাল ওরফে ফজল ওরফে ফজলুর জেল আপিল প্রায় ১২ বছর ধরে বিচারাধীন।  
সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রয়োজনীয় সব নথি-পত্র না থাকায় শুনানি সেসব প্রস্তুত করতে একটি তালিকা করার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। এরপর শুরু হয় তালিকা করার প্রস্তুত করা কাজ। দীর্ঘ সময় নথি ঘেটে দেখা যায় অসম্পন্ন অবস্থায় অন্তত ৫২৯টি জেল আপিল রয়েছে। এছাড়া আরো বাড়তে পারে বলে সূত্রে জানা যায়। আপিলগুলো হাইকোর্টে পড়ে রয়েছে। রায়ের কপি সঙ্গে নেই। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে রায়ের কপি পাঠাতে ৩৬টি কারাগারে চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্ট। চিঠিতে বলা হয়, জেল আপিলের সঙ্গে রায়ের কপি পাওয়া যায়নি। রায়ের কপি পরবর্তীতে পাঠানোর শর্তে আবেদন পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এরপর আর রায়ের কপি পাঠানো হয়নি। আর রায়ের কপি ব্যতীত আবেদনগুলো কোর্টে উপস্থাপন করা হলে বিচারপতিগণ বিব্রত বোধ করেন এবং সংশ্লিষ্ট শাখাকে রায়ের কপি দ্রুত সংগ্রহের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, অনেকের এরই মধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। রায়ের কপি না থাকায় বন্দীদের জেল আপিলের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই উল্লেখিত আবেদনের বিপরীতে রায়ের অনুলিপি এবং জেল আপিলসমূহে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোন বন্দী কারাগারে আটক রয়েছে কি না তা জানাতে বলা হয় চিঠিতে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জেল

৪ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ