প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
মিজানুর রহমান তোতা : মুসলিম স্থাপত্যের অসংখ্য অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমে। যা চাক্ষুষ ইতিহাস। যশোর ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা এলাকার নিদর্শনগুলোর কোনটি সংরক্ষণ হয়, কোনটি হয় না। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বারো আওলিয়ার পুণ্যভূমি বৃহত্তর যশোরের বারোবাজার। সেখানে মাটি খুঁড়ে বের করা মসজিদ আর মসজিদ। মুসলিম স্থাপত্যের বড় প্রমাণ এটি। সেসব মসজিদ আধুনিক অনেক স্থাপত্যকে হার মানিয়েছে। যার জন্য বারোবাজার এলাকাটি পরিচিতি পেয়েছে মসজিদ নগরী হিসেবে। বেশ কয়েকবছর আগে আবিষ্কৃত এই পুরাকীর্তি মাটির ঢিবি খুঁড়ে ও বনজঙ্গল কেটে বের করা হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বারোবাজারের অপূর্ব নিদর্শনগুলো। মুসলিম রীতি অনুসৃত অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন হচ্ছে ঐতিহাসিক বারোবাজারের বহুবছর আগের মসজিদগুলো। ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদের তীরে ও যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের গা ঘেঁষে সুলতানি আমলে গড়ে ওঠে বারোবাজারে অসংখ্য মসজিদ, গাজী, কালু ও চম্পাবতির মাজার ও ছয় কুড়ি ছয়টি অর্থাৎ ১শ ২৬টি দীঘি ও পুকুর। একদিন হয়তো বা বারোবাজারের ঝলমলে আলোকে অন্ধকারের হাতে সমর্পণ হয়েছিল। মাটিতে ঢেকে গিয়েছিল মসজিদগুলো। স্থানীয়দের মাধ্যমে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর মাটি খুঁড়ে বের করে মসজিদগুলো। এইার অপূর্ব নিদর্শনগুলো সম্পর্কে দেশে-বিদেশে প্রচারের মাধ্যমে দর্শনীয় স্থান করে এলাকাটিকে উন্নয়নের সুযোগকে কাজে লাগানোর দাবি ছিল এলাকাবাসীর। কিন্তু দাবি পূরণ হয়নি অনেক দেন দরবারের পরও।
আসলে চোখে না দেখলে সহজে কাউকে বুঝানো যাবে না যে এত সুন্দর সুন্দর মসজিদ কীভাবে একদিন গড়ে উঠেছিল। কারা এর উদ্যোক্তা-এ প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে ফিরছেন অনেকে। একই এলাকায় এত মসজিদ আর প্রতিটি মসজিদের পাশে বড় বড় দীঘি ও পুকুর দেশের কোথাও আছে বলে মনে হয় না। তবে বারোবাজারের মতো দেশের অনেকস্থানে প্রাচীন মসজিদ ছিল বা আছে, যা ইতিহাস ঘাটলে প্রমাণ পাওয়া যায়। মাটির ঢিবি খুঁড়ে বের হওয়া সুন্দর সুন্দর মসজিদ দেখার জন্য এখনো অনেক মানুষ বারোবাজারে ভিড় করেন। কিন্তু যাতায়াত নেই শুধু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। যার জন্য অযতœ ও অবহেলায় পড়ে আছে ঐতিহাসিক মূল্যবান মসজিদগুলো। একটি কিংবা দু’টি মসজিদ নয়, অসংখ্য মসজিদ। কোনটা ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। আবার কোনটার ধ্বংসাবশেষ এখনো পড়ে আছে অযতœ অবহেলায়। আসলে কোন সময়ে মসজিদগুলো নির্মিত তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া দুষ্কর। যশোর-খুলনার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের প্রতœসম্পদ বই দু’টিতেও বারোবাজারের স্থাপত্যের ব্যাপারে প্রকৃত সন-তারিখও পাওয়া যায়নি। তবে যতটুকু তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়েছে তা যথেষ্টই বলা যায়। কারণ ওইটুকু না থাকলে ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেত। নতুন প্রজন্মকে পুরাকীর্তির ব্যাপারে কিছু জানানো হতো কঠিন। সেক্ষেত্রে ওই বই দু’টিসহ পুরাকীর্তি সম্পর্কে আরো যেসব বই রয়েছে তা থেকে গবেষকগণও অনেক উপকৃত হয়েছেন এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। বারোবাজারের পুরাকীর্তির ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধারণা করা যায় সুলতানি আমলের স্থাপিত বারোবাজারের মসজিদগুলো। এ নিয়ে আসলে একেবারে যে গবেষণা চলেনি তা নয়, তবে সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি পাবার ক্ষেত্রে বেশ জটিলতার সৃষ্টি হয়। আবার একই ধরনের ধারণা থেকে পাওয়া যায় খান জাহান আলী (রহ.) ও অন্যান্য পীর আওলিয়াগণ বারোবাজারের মসজিদগুলো নির্মাণ করেছিলেন। শুধু যশোরের বারোবাজারে নয়, যশোর-খুলনা অঞ্চলে অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ আছে। সেসব মসজিদেরও কোনটি এখন ব্যবহার হচ্ছে, আবার কোনটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।
সুলতানি আমলে কিংবা তারপরে খান জাহানের একক প্রচেষ্টায় যশোর, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ, দীঘি ও পুকুর স্থাপিত হয়। যা সম্রাট শাহাজানের কীর্তির সঙ্গে অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায। সেই সময় শুধু মসজিদ ও দীঘি নয়, মাদ্রাসা, মাজার, আবাসিক গৃহ, সেতু, পাকা সড়ক ও হাম্মামখানাসহ বিভিন্ন ইমারত নির্মিত হয়। সুলতানি আমলের বহু ইমারতে বিশেষ করে মসজিদের বাইরের দেয়ালে ও মেহরাবে অতি সুন্দর পোড়ামাটির ফলক চিত্রের অলঙ্করণ ছিল। খান জাহান আলীর (রহ.) মসজিদগুলোর গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশলে একটু বৈশিষ্ট পরিলক্ষিত হয়। এক বা একাধিক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদগুলোর চারদিকের প্রাচীর অত্যন্ত প্রশস্ত। উপরের গম্বুজ ছিল পেয়ালা আকৃতির। যা দিল্লির তোঘলকী স্থাপত্যের প্রভাব ছিল বলে প-িতগণ ধারণা করেন। বারবাক শাহ ও তার পরবর্তী সময়ে নির্মিত মসজিদগুলোর দেয়াল একটু কম প্রশস্ত ছিল। গম্বুজের আকারেও ছিল পার্থক্য। এক গম্বুজ থেকে একাধিক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তার মধ্যে যশোরের বারোবাজার, পটুয়াখালীর মসজিদ বাড়ি মসজিদ, বরিশালের কসবা মসজিদ, দিনাজপুরের চেহেলগাজী মসজিদ, পাবনার শাহাজাদপুর মসজিদ, ফরিদপুরের সাতৈর মসজিদ, নোয়াখালীর বজরা মসজিদ ও বগুড়ার মহাস্থান মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
দক্ষিণ-পশ্চিমের মসজিদ নগরী সম্পর্কে জানা যায়, যশোর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে যশোর-ঝিনাইদহ হাইওয়ে সড়কের পাশে ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদের পাড়ে বারোবাজার একটি প্রাচীন স্থান। সেখানে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। উদ্ধার হয় ধ্বংসাবশেষ। যা ছিল মাটির ঢিবির নিচে। প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে মসজিদ আর দীঘি ও পুকুর পাওয়া যায়। ছয় কুড়ি ছয়টি অর্থাৎ ১শ ২৬টি দীঘি ও পুকুর। ১৯৬১ সালে সর্বপ্রথম খুলনার প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বারোবাজারে বড় বড় ঢিবির নিচে বহু কীর্তির ধ্বংসাবশেষ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আবিষ্কার করে। সেই থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয় ঢিবি খনন কাজ। বের হয়ে আসে একেকটি সুন্দর মসজিদ। সত্যিই চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। স্থাপত্য নকশা অনেকটা আধুনিক নকশাকে হার মানিয়েছে। আজকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ছোট ছোট ইট ব্যবহৃত হচ্ছে বড় কিংবা মাঝারি ইটের বদলে। আর সেই সময় এতটা ছোট ইট ব্যবহৃত হতো এবং পোড়া মাটির তৈরি মেহরাব, খিলান ও গম্বুজ তৈরি করা হতো যা অনেকটা আশ্চার্যই মনে হবে। জানা যায়, বারোবাজারের সাতগাছিয়া ও চেরাগদানী গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে জোড়বাংলা মসজিদ, গোরাই মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ ও চেরাগদানী মসজিদসহ নাম না জানা অন্তত ৭টি মসজিদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মাটির ঢিবি ও বনজঙ্গল কেটে মসজিদগুলো বের করা হয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। বারোবাজারে মসজিদ এবং দীঘি ও পুকুর ছাড়াও বেড়দীঘির দক্ষিণপাড়ে বাংলাদেশের কিংবদন্তি গাজী-কালু-চম্পাবতীর কবর পাওয়া যায়। সবগুলোই সংস্কার করেছে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর।
জানা যায়, ১৯৬১ সালে বারোবাজারের ধ্বংসাবশেষ বেশ কয়েকটি মসজিদের সন্ধান পেলেও প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর পর্যায়ক্রমে টানা ১৯৯৩-৯৪ সাল পর্যন্ত মাটির ঢিবি খুঁড়ে মসজিদ বের করা হয়। সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগীও করা হয় কয়েকটি মসজিদ। মসজিদ সংলগ্ন ও মসজিদের বাইরে যে মোট ১শ ২৬টি দীঘি ও পুকুর পাওয়া গেছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটির নাম পাওয়া গেছে। তা হলো, সওদাগার দীঘি, পীর পুকুর, চেরাগদানী দীঘি, গলাকাটার দীঘি, মিঠাপুকুর, নুনগোলা পুকুর, খাঁ পীরের দীঘি, সাতারে দীঘি, আঁলেখা দীঘি, সাত পুকুর, হাঁস পুকুর, বিশ্বাসের দীঘি, রাজার দীঘি, চাউল ধোয়া দীঘি, ফ্যান ঢালা দীঘি, কোদাল ধোওয়া ও ডাল ধোওয়া দীঘিসহ বিভিন্ন নামের দীঘি ও পুকুরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যশোর-খুলনার ইতিহাস বইতে। বারোবাজার এলাকায় প্রাচীন মসজিদ ও বড় বড় দীঘির এলাকায় গেলে যে কারো প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। একসময় হয়তো জনবসতি ছিল সেখানে। হয়তো ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোন দুর্যোগে মানবিক বিপর্যয়ের পর মসজিদগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। প্রতœতত্ব অধিদপ্তরের খননের আগে মানুষ বড় মাটির ঢিবি হিসেবেই জানতো। পরে মসজিদের পর মসজিদ মাটির ঢিবি খুঁড়ে বের করার পর ওটি আসলে ‘মসজিদের নগরী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন লোকজন। দেখা গেছে, যশোর-ঝিনাইদহ হাইওয়ে সড়ক থেকে বাজারের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা একে বেকে পশ্চিম দিকে গ্রামের মধ্যে চলে গেছে। পাকা রাস্তার দুইপাশে বাজার, স্কুল, অফিস ও বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে বেশ আগেই। তবে এসবের বেশ কয়েক কয়েক বছর আগেও যখন রাস্তাটি কাঁচা ছিল তখন এলাকাটি ছিল প্রায় একেবারেই ফাঁকা। এই তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে। রাস্তা ধরে একটু এগুলেই প্রথমে চোখে পড়বে রাজমাতার দীঘি। প্রায় ৩৩ বিঘা জমিজুড়ে দীঘিটি অবস্থিত। যার অস্তিত্ব এখনো রয়েছে ভালোভাবেই। আসলে ওটি রাজমাতার দীঘি কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ মুসলমানদের দীঘি সাধারণত পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা হয়। এ কারণে সবারই ধারণা রাজমাতার দীঘি নামকরণ করা হলেও আসলে ওটি রাজমাতার দীঘি নয়। কেউ কেউ আবার অবশ্য বলেন, ওটি খাঞ্জানী দীঘি। তার পাশেই আছে সাওদাগার দীঘি। যা ৩৬ বিঘা জমির উপর। পাশেই ছিল বিরাট ঢিবি। মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে সেখান থেকে সওদাগারের মসজিদ। এটিও বেশ বড় মসজিদ। আর একটু এগুলে দেখা যাবে গোরাই মসজিদ। লোকে বলে গোড়ার বা গোরাই মসজিদ। মসজিদ থেকে প্রায় ৩০ গজ দূরে পূর্ব দিকে প্রায় ৪/৫ বিঘা আয়তনের একটি প্রাচীন দীঘি আছে। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদটির প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে প্রায় ৩০ ফুট ও ভেতরের দিকে ২০ ফুট লম্বা। দেয়ালগুলো ৫ ফুট প্রশস্ত। চারকোণে ৪টি সুন্দর অষ্টোকোণাকৃতির মিনার আছে। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দরজা বরাবর ৩টি মেহরাব। বহুবছর পরে হলেও মেহরাবগুলোতে পোড়ামাটির ফলকের সৌন্দর্য মোটেও নষ্ট হয়নি। মসজিদের অভ্যন্তরে চার দেয়ালের কেন্দ্রস্থলে ও দেয়াল ঘেঁষে ৪টি পাথরের স্তম্ভ আছে। চারটি স্তম্ভ¢ ও চারপাশের দেয়ালের উপর মসজিদের একমাত্র গম্বুজ প্রতিষ্ঠিত। জোড় বাংলার মসজিদ : গোরাই মসজিদ থেকে কিছু দূরে এবং রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি মাঝারি আকারের প্রাচীন দীঘি আছে। দীঘির পশ্চিমপাড়ে পরস্পর সংলগ্ন দু’টি ঢিবি ছিল। ঢিবি কেটে বের করা হয় জোড়বাংলার মসজিদ। দু’টি মসজিদ প্রায় দুই বিঘা জুড়ে অবস্থিত। কোথাও এমন ধরনের জোড়া মসজিদ সাধারণত দেখা যায় না। তবে পাবনায় জোড়বাংলা একটি মসজিদের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। চেরাগদানী মসজিদ ও দীঘি : গলাকাটা মসজিদ থেকে আনুমানিক দেড়শ’ গজ দূরে একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়েছে। মসজিদের পাশের বিরাট দীঘি রয়েছে। দীঘির পানি খুব স্বচ্ছ। মসজিদের প্রত্যেক বাহু ভেতরের দিকে প্রায় ২০ ফুট দীর্ঘ। দেয়ালগুলো সাড়ে ৪ ফুট প্রশস্ত।
বৃহত্তর যশোর জেলায় বারোবাজার ছাড়াও প্রাচীন বহু মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ঝিনাইদহের শৈলকুপা শহরে কুমার নদীর পাড়ে শৈলকুপা মসজিদ ও মাজার। যশোর-খুলনার ইতিহাসে উল্লেখিত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গে সুলতানী আমলের স্থাপত্য কীর্তির একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। মসজিদটি যেখানে অবস্থিত সেই স্থানের নাম ছিল দরগাপাড়া। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এই মসজিদের আয়তন ভেতরের দিকে সাড়ে ৩১ ফুট লম্বা ও ২১ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় সাড়ে ৫ ফুট প্রশস্ত। চারকোণে আছে ৪টি মিনার। এগুলো গোলাকার এবং বলয় আকারের স্ফীতরেখা (ব্যান্ড) দিয়ে অলঙ্কৃত। মিনারগুলো মসজিদের অনেক উপরে উঠে গেছে। মসজিদটি ইটের তৈরি। পরবর্তীতে মসজিদটি বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করে এতটা আধুনিক করা হয়েছে যে, এর আদি রূপ কি ছিল তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। শুভরাঢ়া মসজিদ : যশোরের অভয়নগর উপজেলা সদর থেকে কয়েক মাইল দূরে দক্ষিণ-পূর্বদিকে এবং ধুলগ্রাম থেকে উত্তরে ভৈরব নদীর তীরে একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আছে। বর্গাকারে নির্মিত ছোট মসজিদটির প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে। দেয়ালগুলো সাড়ে ৫ ফুট প্রশস্ত। চারকোণে ৪টি মিনার। মসজিদের গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল দেখে বলা যায় ওটি খান জাহান আলী (রহ.) আমলে নির্মিত হয়েছিল। জানা যায়, খান জাহান আলী বারোবাজার থেকে যশোর মুড়লী, কসবা হয়ে পয়োগ্রাম কসবা গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে যান বাগেরহাটে। তিনি পথিমধ্যে শুভরাঢ়ায় অবস্থান করে সেখানে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৬০ গম্বুজ মসজিদ : বাগেরহাটে খান জাহান আলীর (রহ.) মাজার থেকে মাত্র দেড় মাইল পশ্চিম-উত্তরে ঘোড়া দীঘির পূর্ব তীরে সুন্দরঘোনা মৌজায় অবস্থিত ষাট গম্বুজ মসজিদ। বাংলাদেশের প্রাচীন আমলের মসজিদগুলোর মধ্যে এটি বৃহত্তম। অবিভক্ত বাংলার আদিনা মসজিদ ও বড় সোনা মসজিদের পরেই ছিল এর স্থান। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ মসজিদের আয়তন বাইরের দিকে ১শ ৫৯ ফুট ৮ ইঞ্চিক্ষাই ১শ ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং ভেতরের আয়তন ১৪৩ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা ও ৮৮ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া। দেয়ালগুলো ৯ ফুট প্রশস্ত। চারকোণে আছে ৪টি বিরাট আকারের মিনার। গোলাকার মিনারগুলো দুই ধাপে নির্মিত এবং ক্রমশঃ সরু হয়ে উপরে উঠেছে। সিঙরা মসজিদ : ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ৩শ গজ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সুন্দর ঘোনাগ্রামে সিঙরা মসজিদ নামে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে ৩৯ ফুট ও ভেতরের দিকে ২৫ ফুট লম্বা এবং প্রাচীর প্রায় ৭ ফুট প্রশস্ত। বেগিনীর মসজিদ : ঘোড়া দীঘির পশ্চিম পাড় থেকে প্রায় ৩শ গজ পশ্চিমে অবস্থিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ খান জাহান আলীর (রহ.) আর এক বিরাট কীর্তি। দেয়াল খান জাহান আলীর আমলের ইটের তৈরি ও প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত। দীর্ঘকাল প্রাচীন মসজিদটি বহুকাল ধরে জীর্ণ ও পরিত্যক্ত ছিল। পরে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরসংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। চুনাখোলা মসজিদ : বিবি বেগিনী মসজিদের প্রায় ৫শ গজ উত্তর-পশ্চিমে চুনাখোলা গ্রামের মাঠের মধ্যে চুনাখোলা প্রাচীন মসজিদটি অবস্থিত। চারিদিকে আবাদি জমির মাঝে লোকালয়ের বাইরে ভগ্ন মসজিদের অস্তিত্ব যেন নিঃসঙ্গতার বেদনার প্রতীক। দীদার খাঁর মসজিদ : খান জাহান আলীর (রহ.) বসতবাড়ী ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ১ মাইল উত্তরে ভৈরব নদীর পাড়ে। সেখানে তার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তার একটু দূরেই ছিল দীদার খাঁর মসজিদ। মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সেখানে। মসজিদের প্রত্যেক বাহু ছিল ৫৪ ফুট। গম্বুজ ছিল ৯টি। প্রধান গম্বুজটির ব্যাস ছিল ১৪ ফুট। রণবিজয়পুর মসজিদ : খান জাহান আলীর বাড়ি থেকে প্রায় দেড় মাইল পূর্বদিকে রাস্তার দক্ষিণ পাশে রণবিজয়পুর গ্রামের আরেকটি প্রাচীন মসজিদ আছে। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে ৫৬ ফুট ও ভেবতেরর দিকে ৩৬ ফুট লম্বা। প্রাচীর প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত। পেয়ালা আকারে নির্মিত বিরাট উঁচু গম্বুজ দর্শনীয় বস্তু। হোসেন শাহী মসজিদ : রণ বিজয় মসজিদ থেকে আরো এক মাইল পূর্বদিকে বাগেরহাট শহরে যাবার পথে পাকা সড়কের পাশে কৃঞ্চনগর গ্রামের আরো একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। ৬০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া মসজিদটির প্রাচলি ৬ ফুট প্রশস্ত। মসজিদের উপরে ২ সারিতে ১০টি গম্বুজ আছে। মসজিদ কুড় মসজিদ : খুলনা শহর থেকে প্রায় ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে সাতক্ষীরার আমাদী গ্রামের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে মসজিদ কুড় মসজিদ আছে। বারোবাজারের মতো মাটি খুঁড়ে ও জঙ্গল কেটে মসজিদটি আবিষ্কার করা হয়। ওটিও খান জাহান আলীর (রহ.) সময়ে প্রতিষ্ঠিত বলে জানা যায়। সুন্দরবন অঞ্চলের অবিস্মরণীয় কীর্তি ওই মসজিদটি। ফকিরহাট মসজিদ : ফকিরহাটে একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ ছিল বলে যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখিত আছে।
গোটা অঞ্চলে প্রাচীন মসজিদ কতটা আছে। তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সতীশ চন্দ্রের যশোর-খুলনার ইতিহাস ও আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার বাংলাদেশের প্রতœসম্পদ বই দু’টিতে অসংখ্য প্রাচীন মসজিদের বিবরণ দেয়া আছে। সেই সময় আসলে গবেষণা করে প্রাচীন মসজিদ আবিষ্কার করা হয়েছে। তারই সুত্র ধরে প্রতœতত্ত অধিদপ্তর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছে বহু মসজিদ, দীঘি ও পুকুর। এ অঞ্চলের প্রায় সব ক’টি মসজিদের পাশেই রয়েছে পুকুর বা দীঘি। স্থাপনা শৈলীও কোনটা কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও সবই প্রায় একই ধাচের। প্রাচীন মসজিদের পুরনো গবেষণা ছাড়া নতুন করে কোন গবেষণা হয়নি। উদ্যোগও তেমন নেই। সরকারিভাবে বারেবাজারসহ গোটা অঞ্চলের প্রাচীন মসজিদের আবিষ্কার, গবেষণা, সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সঠিক ইতিহাস রচনা করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তাহলে আগামী প্রজন্ম এ ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাবে। তা না হলে অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। সেটি হবে পেয়ে ধন হারানোর মতো অবস্থা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইতিহাস ঘেটে যেটি পাওয়া যাচ্ছে তাতে যশোর-খুলনা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মসজিদের সিংহভাগই খান জাহান আলী (রহ.) আমলের। তার প্রকৃত নাম কি ছিল তা নিয়েও বেশ বিতর্ক করা হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। খান জাহান আলী (রহ.) তার নির্মিত ইমারতগুলোতে ইটের পাশাপাশি অসংখ্য পাথরও ব্যবহার করেছিলেন। ধারণা করা যায় যা বাইরে থেকে আমদানিকৃত। বাগেরহাটের সুপ্রতিষ্ঠিত খাঞ্জালী দীঘির উত্তর তীরে একটি প্রাচীর বেষ্টিত স্থানে খান জাহান আলীর মাজার অবস্থিত। সেখানেই তিনি চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। ধারণা করা হয় তিনি জীবিতকালেই মাজার ইমারত নির্মাণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে টানা কয়েক বছর তিনি সেখানেই বসবাস করতেন। শুধু প্রাচীন মসজিদ নয়, বাংলাদেশের প্রাচীন যুগের ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন। বিভিন্ন বইপত্র ঘেটে ও বাস্তবে অনুসন্ধান চালিয়ে নতুন করে গবেষণা করার উদ্যোগ নেয়া আসলে খুবই জরুরি পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত। তাদেও মতে, বারোবাজার মসজিদ ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে আরো গভীরভাবে গবেষণার ব্যবস্থা করলে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে এতে সন্দেহ নেই। অতীতের গবেষণায় যা বের হয়েছে তার চেয়ে আরো কিছু আবিষ্কার হতে পারে এমন ধারণা কিন্তু অনেকেরই মধ্যে বদ্ধমূল রয়েছে। কারণ দৃশ্যত বারোবাজার একটি গ্রাম হতে পারে। কিন্তু সেটি কিন্তু ইতিহাস। যতগুলো মসজিদ, দীঘি ও পুকুর আবিষ্কার হয়েছে তার চেয়ে আরো বেশি মসজিদ কিংবা মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া গেলে অবাক হবার কিছুই থাকবে না।
পরিশেষে বলবো, সবারই প্রত্যাশা বারোবাজারসহ যশোর-খুলনা এবং গোটা দেশের মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শনগুলো যতœসহকারে সংরক্ষণ করা হোক। গবেষণা করে নতুনভাবে রচনা করা হোক সঠিক মসজিদ নগরীর সঠিক ইতিহাস। যাতে আগামী প্রজন্ম অনুমান নির্ভর নয়, সত্যিকারার্থে বাস্তবভিত্তিক সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। এই প্রত্যাশা পূরণে নিশ্চয়ই সরকার আন্তরিক হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।