হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : এ মুহূর্তে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম না থাকলেও রাজনৈতিক মামলাবাজি, বিরোধিদলের নেতাকর্মীদের উপর পুলিশি হয়রানির ধারাবাহিক প্রবণতা থেমে নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে এবং পরে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে আওয়ামী লীগ সরকার পুরোপুরি পুলিশ নির্ভর হয়ে পড়েছিল। বিরোধিদলকে নানাভাবে দুর্বল করতে, আন্দোলন দমনে অথবা একপাক্ষিক নির্বাচনের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে একদিকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি অন্যদিকে জনপ্রশাসনের আমলারাই যেন সরকারের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছিল। কর্তৃত্ববাদি শাসনে সরকারি দলের ভবিষ্যৎ এবং সরকারের প্রতি জনসমর্থন কোথায় যাচ্ছে, এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা এখনো বেতোয়াক্কা, বেপরোয়া। পুলিশ ও আমলাদের বশে রাখতে তাদের সব দাবি-দাওয়া সরকার যেন স্বতঃস্ফ‚র্তভাবেই পূরণ করতে সদা ব্যস্ত। দেশের শিক্ষক সমাজের লাখ লাখ সদস্য বছরের পর বছর ধরে রাজপথে আন্দোলন করেও যেখানে নিজেদের ন্যূনতম অধিকার আদায় করতে পারছেন না, এমপিওভুক্ত হাজার হাজার স্কুলে গণিত ও ইংরেজির শিক্ষক সঙ্কটে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে হাজার হাজার বেসরকারি স্কুল, মাদরাসা এমপিওভুক্ত হতে পারছে না। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদমর্যাদার অবনমন করে সরকারি আমলাদের বেতন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করা হচ্ছে এবং পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সরকারি আমলা, পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা এদেশেরই সন্তান, নাগরিক। তাদের বেতন ও সযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিকে অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই। তবে একই সাথে শিক্ষক সমাজ এবং সাধারণ নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা ও জীবন মান উন্নয়নের দাবি-দাওয়াগুলোর বাস্তবায়ন সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। সেসব দাবিকে প্রকারান্তরে অবজ্ঞা করে শুধুমাত্র আইনানুগ অস্ত্রধারি বাহিনী এবং সরকারি আমলাদের মনোরঞ্জনে সরকারের আগ্রহকে দেশের সাধারণ মানুষ এবং অন্য পেশাজীবীরা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। পুলিশ ও আমলাদের প্রতি সরকারের পক্ষপাত সত্তে¡ও জনগণের ট্যাক্সের টাকায়প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের সেবক অথবা জনবান্ধব বাহিনী হয়ে উঠতে পারছে না। এরাই যেন এখন দেশের মালিক-মোক্তারে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিমূলক কর্মকাÐে লিপ্ত থাকার ঘটনা কোন নতুন বিষয় নয়, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের এই শ্রেণীর সদস্যের সংখ্যাবৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের বেপরোয়া, দুর্বিনীত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে।
প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার গ্রেফতার বাণিজ্য ছাড়াও বেআইনী ও অপরাধমূলক নানা ধরনের কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়ার জোরালো অভিযোগ আছে পুলিশ বাহিনীর এক শ্রেনীর সদ্যসের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বাড়লেও পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে অনেক সৎ, যোগ্য-দক্ষ সদস্য রয়েছেন, যারা জনগণের নিরাপত্তায় জীবন বাজি রেখে প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করছেন। তবে অপরাধী পুলিশের সংখ্যাও কম নয়, গত বছর পুলিশ বাহিনীর ১০ হাজারের বেশি সদস্যের নানা অভিযোগে বিভিন্ন মাত্রার বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। বছরে হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার পরও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে অপরাধী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া। অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দু’চার বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর ঘটনাক্রমে কোন লঘু-গুরু অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে তিরস্কার, বদলি, পুলিশ লাইনে ক্লোজ, পদাবনমন বা সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার মত শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনেককে। নামে- বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর চাকরিচ্যুতির শাস্তিকে তার হয়তো পাত্তা দেয়ার প্রয়োজনই বোধ করে না। এ কারণেই বছরে ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পুলিশে অপরাধের পরিমাণ ও মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ১০০ জন অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধেও যদি অপরাধের মাত্রা ভেদে মৃত্যুদÐ, যাবজ্জীবন কারাদÐ, চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মত দৃষ্টান্ত থাকতো, তাহলেই পুলিশের বেপরোয়া অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভবপর হতো। তবে, শুধুমাত্র শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই পুলিশ বাহিনীকে অপরাধমুক্ত, জনবান্ধব ও জনগণের আস্থাশীল পুরোগামি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং উপযুক্ত মানদÐ রক্ষার যাবতীয় প্রথা-পদ্ধতি অনুসরণ খুবই জরুরি। পুলিশে নিয়োগ, পদন্নোতি, পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও আঞ্চলিকতার মত নানা মাত্রিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একেকজন কনস্টেবল কে নিয়োগ পেতে ৩ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এএসআই, এসআই থেকে থানার ওসি, এএসপি, এসপি, ডিআইজি, কমিশনার র্যাঙ্কে নিয়োগ, পদন্নোতি বা বদলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য, উপর মহলে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ অঞ্চলের লোকদের প্রাধান্য দিয়ে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূর্ণ করার কথাও লোকসমাজে চাউর আছে। প্রভাবশালী মন্ত্রীদের সাথে ব্যক্তিগত আত্মীয়তা বা বিশেষ সম্পর্কের দাবিদার পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ যদি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডিঙ্গিয়ে বাহিনীতে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করেন, তাহলে বাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। কিছু দুর্নীতিবাজ, অপরাধী পুলিশ সদস্যের অপরাধের দায়ভার পুরো বাহিনীকেই বহন করতে হয়। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী জনগণের আস্থা হারায়। এমনকি এদের কর্মকাÐে বিদেশেও দেশের ভাব-মর্যাদার অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতার মসনদকে নিষ্কণ্টক রাখতে বিরোধীদল দমনের কাজে পুলিশ বাহিনীকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ও হচ্ছে। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মকাÐের বিরুদ্ধে পুলিশের খড়গহস্ত যতই প্রসারিত হচ্ছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা যতই বলা হচ্ছে, দেশের মানুষ ততই নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে, সন্ত্রাসী হামলা, অপহরণ, অপমৃত্যু ও নাশকতার ঘটনা ততই বাড়ছে। বিরোধীদলের লাখ লাখ নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ পুলিশের সন্দেহভাজন হিসেবে একপ্রকার জিম্মিদশায় পতিত হয়েছে। সরকারের এই রাজনৈতিক পুলিশনীতি শেষ পর্যন্ত তার জন্য বুমেরাং হয়ে উঠছে কিনা, এরই মধ্যে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ। প্রত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তরুণ কর্মকর্তা মোহাম্মদপুরে তার খালার বাসা থেকে কল্যাণপুরে নিজ বাসায় যাচ্ছিলেন, হঠাৎ এসআই মাসুদ পেছন থেকে তারশার্টের কলার চেপে ধরে বলেন, তোর কাছে ইয়াবা আছে। গোলাম রাব্বী অস্বীকার করলেও তাকে গাড়িতে তুলে নির্যাতন করা হয়, ক্রস ফায়ার এবং মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে তার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়। ঘটনাটি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায় এবং প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্ত এসআই মাসুদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। অতঃপর বিভিন্ন রিপোর্টে এসআই মাসুদের সন্ত্রাসী-অপরাধী চরিত্রের নানাকীর্তি এবং স্বল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার তথ্যাবলীও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। পুলিশ বাহিনীতে এসআই মাসুদের মত অপরাধীরা রয়েছে যারা জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে গ্রেফতার বাণিজ্যসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করছেন গণডাকাতি, অপহরণ বা টার্গেটেড কিলিংয়ের কাজে। গত সপ্তায় (৯ জানুয়ারি) মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারের হাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা নির্যাতিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানার পুলিশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে আহত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশের হাতে এভাবেই নির্যাতিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সব সংবাদ পত্রিকার পাতায় উঠে আসে না। প্রথমত, রাজধানীতে দু’জন সরকারি কর্মকর্তা প্রায় একই সময়ে সন্ত্রাসী কায়দায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হওয়ায় তা আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাকে নির্যাতনকালে যাত্রাবাড়ি থানার পুলিশ কর্মকর্তার দম্ভোক্তি থেকেই পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তার বেপরোয়া হয়ে ওঠার মনস্তত্ব বুঝা যায়। ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’ উক্তিকে ভয়ানক বলে অভিহিত করেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে যতই প্রশ্ন উঠুক, সরকারি কর্মকর্তারা সব সময়ই জনগণের সেবক। একজন সন্ত্রাসী-অপরাধী পুলিশ সদস্য পুলিশকে দেশের রাজা দাবি করলেই তা পুলিশ বাহিনীর দাবি হিসেবে গ্রাহ্য হয় না। তবে এ থেকে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের বেপরোয়া হয়ে ওঠার চারিত্র্য লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পুলিশে অপরাধ বাড়ছে, এ কথা স্বীকার করে বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের অপরাধের দায় পুরো বাহিনী নিবে না বলে দাবি করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের কাউন্সিলিংয়ের অধীনে নেয়ার কথা বলছেন। কিন্তু পুলিশ নিয়োগের সময় নিয়োগ বাণিজ্য, দলবাজি, আঞ্চলিকতাসহ প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই পুলিশে চাকরি ও পদায়নের পথ অবারিত রেখে পুলিশের অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদরাসা ছাত্রদের সাথে দোকানদার ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে অতি সম্প্রতি কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার অতি উৎসাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি ঐতিহ্যবাহী মাদরাসায় মধ্যরাতে হামলা চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। জামেয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় অভিযান চালানোর সময় পুলিশ মাদরাসা ছাত্রদের কক্ষ তছনছ করেছে, তাদের উপর বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে, মাথা বুট দিয়ে চেপে ধরেছে, গুলি করার পর কোরানে হাফেজ এক ছাত্রকে তিন তলা থেকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়ার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে এ সংবাদ জনমনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গত ১১, ১২ জানুয়ারি হঠাৎ করেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে পুরো শহরকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ত্রিমুখী সংঘর্ষে ২৫ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৭০ জন আহত হয়, পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে বিজিবি মোতায়েন করার পরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সার্বিক পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিহত ছাত্রের লাশ হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও স্থানীয় জনতা শহরের সব রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস, সংসদ সদস্যের কার্যালয়, রেলস্টেশনে ভাঙ্গচুর অগ্নিসংযোগ করে। তারা তাৎক্ষণিকভাবেই পরবর্তী দিন হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করে। শহরে বিজিবি নামানোর পরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে মাদরাসা শিক্ষকদের প্রায় সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করাসহ তাদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে বাধ্য হয় স্থানীয় প্রশাসন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে মাদরাসায় হামলা ও হত্যাকাÐের ঘটনায় তাদের দায় প্রাথমিকভাবে স্বীকার করা হয়েছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রমাণীত হয়, পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের বেপরোয়া কর্মকাÐে পুরো পুলিশ বাহিনীকে বড় ধরনের দুর্নাম বহন করতে হয়। কখনো কখনো সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বা গণভিত্তি প্রশ্নের মধ্যে পড়ে যায়। পুলিশ সদস্যদের বাড়াবাড়ির কারণে কোথাও কোথাও গণবিস্ফোরণ ঘটতে দেখা যায়। কখনো কখনো গণবিস্ফোরণ স্থানীয় পর্যায় থেকে বিস্তৃত হয়ে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের পতন পর্যন্ত হতে পারে। সরকার বিরোধী গণবিক্ষোভ এমনকি দেশের সীমা পেরিয়ে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। ২০১১ সালে সমগ্র আরব বিশ্বে যে উন্মাতাল আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল, তার শুরুটা ছিল তিউনিসিয়ায় একজন পুলিশ অফিসারের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারী আচরণের প্রতিবাদে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে নিজের গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে হকার যুবক বাউজিজির সেল্ফ ইমোলেশন বা আত্মদহনের মধ্য দিয়ে। এই ঘটনায় জনগণ রাজপথে নেমে আসলে তিউনিসিয়ায় বেনআলীর প্রায় ৩ দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। জনতার রুদ্র রোষ থেকে বাঁচতে বেনআলীকে দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। শাসকদের বিরুদ্ধে জনতার এই বিক্ষোভের ঢেউ তিউনিসিয়ার গÐি পেরিয়ে মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ সমগ্র আরব বিশ্বে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয় তা এখনো শেষ হয়নি। পুলিশের ছাত্রহত্যা ও বাড়াবাড়ির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা যদি শুধুমাত্র শক্তি দিয়ে মোকাবেলার চেষ্টা করা হতো তাহলে হয়তো পরবর্তী পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতো। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সমঝোতামূলক অবস্থান গ্রহণই ছিল সম্ভবতঃ একমাত্র বিকল্প। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দু’জন অপরাধী পুলিশ কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করার মধ্যদিয়ে জনতার হরতাল-অবরোধ ও বিক্ষোভ প্রশমন করা সম্ভব হলেও পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকাÐ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং পুলিশকে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পুলিশ আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। অন্যথায় দেশে আইনের শাসন এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। পুলিশকে দেশের রাজা বানিয়ে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কাক্সিক্ষত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।