Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোয়ানু রোহিঙ্গা বাঁশখালীতে গুলি সোহেল খুন দিয়াজের মৃত্যু

চট্টগ্রামে বছরজুড়ে আলোচনায়

| প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় জনপদে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তা-ব, বাঁশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র  নিয়ে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ৪ জন নিহত, ছাত্রলীগ নেতা নাসিম আহমেদ সোহেল হত্যা ও দিয়াজ ইরফান চৌধুরী রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ছিল চলতি বছরজুড়ে আলোচনায়।
প্রতিবেশী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনসহ সেখানে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার বৃহত্তর চট্টগ্রাম। বার্মা সেনাবাহিনী ও মগদস্যুদের হাতে আরকানে প্রাণ গেছে শত শত রোহিঙ্গা মুসলমানের। ঘরবাড়ি ছাড়া লাখো মানুষ পাহাড়, জঙ্গল আর সাগরে ভাসছে আশ্রয়ের আশায়। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা উখিয়া-টেকনাফে।
চীনা প্রেসিডেন্টকে সাথে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক চট্টগ্রামবাসীর বহুপ্রতীক্ষিত কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের লক্ষ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও ছিল গেল বছরের আলোচিত ঘটনা। চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় শুরু হবে টানেল নির্মাণ কাজ। আবার চট্টগ্রামের উন্নয়নে ফ্লাইওভারের কার্যকারিতা নিয়ে মন্ত্রী-এমপির হাতাহাতিতে জড়ানোর ঘটনাও আলোচিত হয়েছে সর্বত্রই।
বাঁশখালীতে গুলি: গেল বছর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা বাঁশখালীর গন্ডামারায় পুলিশের গুলিতে নিরপরাধ চার গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা। এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গন্ডামারা ইউনিয়নে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে। গত ৪ এপ্রিল গন্ডামারার হাদিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন সমাবেশ ডাকে। এক পর্যায়ে এ নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশের গুলিতে দুই ভাইসহ চারজন নিহত হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন পুলিশ কোন কারণ ছাড়াই গুলি করে চারজনকে হত্যা করেছে। তবে এই ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির মতে প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব হলেও জনগণকে ভুল বুঝিয়ে সেদিন পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হয়েছিল। এ ছাড়া এর পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধনও ছিল। পরে অবশ্য নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয় সরকার ও এস আলম গ্রুপ। অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যে কয়টি বড় প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন তার একটি ওই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প।
 রোয়ানুর তা-ব : গত ২১ মে চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, হালিশহর, সন্দ্বীপ, সীতাকুন্ড, বাঁশখালী, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়ি ঘর, ক্ষেতের ফসল, গবাদি পশু। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মহানগরীর বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ আসাদগঞ্জ। ল-ভ- হয়ে যায় পতেঙ্গা উপকূল। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় মারা যায় অন্তত ত্রিশ জন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। লোকালয়ে প্রবেশ করে সাগরের লোনাপানি। এখনও অনেক এলাকায় রোয়ানুর আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে। সরকারি আশ্বাসের পরও ক্ষতিগ্রস্তরা পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা পায়নি।
সোহেল হত্যা : গত ২৯ মার্চ নগরীর বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াসা মোড় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন মহানগর ছাত্রলীগের উপ-সম্পাদক নাসিম আহমেদ সোহেল। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এমবিএ প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র সোহেল সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অনুষদের ২৩তম ব্যাচের বিদায় অনুষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষ ওই সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। সোহেলকে খুনের জন্য তাৎক্ষণিক মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ছাত্রলীগ দায়ী করা হলেও পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যারা তার উপর হামলা করেছে তারা নাছির উদ্দীনের অনুসারী। কে সোহেলকে ছুরি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে তা স্পষ্ট হয় ওই ফুটেজে। হত্যাকা-ের পরপর ক্যাম্পাস থেকে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন সোহেলের বাবা আবু তাহের বাদী হয়ে ওই পাঁচ জনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন। এখনও ওই মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। ধরা পড়েনি সব আসামী।
দিয়াজের মৃত্যু : গত ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট এলাকার নিজ বাসা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দিয়াজের পরিবারে অভিযোগ টেন্ডারবাজির ঘটনায় তাকে খুন করে লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা এই খুনের জন্য ছাত্রলীগের একাংশের কতিপয় নেতাকে দায়ী করেন। ২৪ নভেম্বর দিয়াজকে হত্যার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুসহ ছাত্রলীগের নয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে তার মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। প্রথম ময়নাতদন্তে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যাজনিত। তা প্রত্যাখ্যান করেন দিয়াজের পরিবারের সদস্যরা। পরে আদালতের নির্দেশে কবর থেকে লাশ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে করা দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আঘাতজনিত কারণে দিয়াজের মৃত্যু হয়েছে। দিয়াজের মৃত্যুকে ঘিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ এখন মুখোমুখি। মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলছে তোলপাড়। আগামীকাল রোববার দিয়াজের বাসায় যাওয়ার কথা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক দলের।
কর্ণফুলী টানেল : গত ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট। নদীর তলদেশে টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ হাজার ৫ মিটার (তিন কিলোমিটারের বেশি)। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুনের মধ্যে টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের। এই টানেল নদীর পূর্ব তীরের আনোয়ারা উপজেলা ও কর্ণফুলী উপজেলাকে চট্টগ্রাম মহানগরীর সঙ্গে যুক্ত করবে। গত ৩০ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের আরও একটি মেগা প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। মহানগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রামের উন্নয়নে আরও কয়েকটি প্রকল্প এগিয়ে  চলছে। তবে এসব উন্নয়ন নিয়ে খোদ সরকারী দলের মন্ত্রী এমপিদের মধ্যেও বির্তক আছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে ফ্লাইওভারের কার্যকারিতা নিয়ে গত ৯ এপ্রিল তুমুল বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয় গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ও সাবেক মন্ত্রী ডা.  আফছারুল আমীনের মধ্যে। তর্কের একপর্যায়ে আফছারুল আমীন মন্ত্রীর দিকে তেড়ে যান। এ সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ বিশিষ্টজনেরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।
 রোহিঙ্গা ইস্যু: গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের আরাকানে সেনাবাহিনী ও মগদস্যুদের বর্বরতম নির্যাতন শুরু হয় নিরপরাধ রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর। গণহারে নারী-শিশু-যুবকদের ধরে হত্যা করা হচ্ছে। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশসহ আশপাশের কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও’র হিসাবে বাংলাদেশে অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ২১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও সরকারি তরফে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ ৯ হাজার বলে দাবি করা হচ্ছে। পৌষের শীতে পাহাড়-জঙ্গলে থাকা সহায়-সম্বলহারা রোহিঙ্গা মুসলিম নর-নারীর করুণ আহাজারি চলছে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায়। সাগরে নৌকাবোঝাই শত শত রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। মিয়ানমারে ইতিহাসের ভয়াবহতম মুসলিম নির্যাতন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ ফুঁসে উঠেছে। চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের ইসলামী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষ এ বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন কক্সবাজার অভিমুখী লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও সরকারি বাধায় তা প- হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার রয়েছে।



 

Show all comments
  • নিজাম ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৮ পিএম says : 0
    সব গুলোর সুষ্ঠ তদন্ত হওয়া দরকার।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ