বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মুমিন মুসলমানগণের জন্য অবিশ্বাসী কাফেরদের অনিষ্ট হতে আত্মরক্ষা করা, সত্য প্রচার করা এবং দুনিয়াতে ন্যায় ও সুবিচার করার একটি কৌশলের নাম হিজরত তথা দেশ ত্যাগ। অর্থাৎ যে দেশে সত্যের বিরুদ্ধে কাজ করতে এবং ন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হতে হয়, সেই দেশ পরিত্যাগ করা। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মুমিন মুসলমান বান্দাহগণকে খেতাব করে আল কোরআনে ইরশাদ করেছেন : হে আমার মুমিন বান্দাহগণ! নিশ্চয় আমার জমিন (পৃথিবী) প্রশস্ত। কাজেই তোমরা আমারই ইবাদত কর। (সূরা আল আনকাবুত : ৫৬)।
সুতরাং শেষ বিচারের দিন কারও এই ওযর গ্রহণ করা হবে না যে, অমুক দেশে বা অমুক শহরে কাফেররা প্রবল ছিল বিধায় আমরা তাওহিদ প্রতিষ্ঠা ও ইবাদত পালনে অপারগ ছিলাম। সুতরাং তাদের উচিত যে দেশে কুফর ও অবাধ্যতা করতে বাধ্য করা হয় আল্লাহপাকের নির্দেশ প্রতিপালনের জন্য সেই দেশ ত্যাগ করা এবং এমন কোনো স্থান তালাশ করা, যেখানে স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে আল্লাহপাকের নির্দেশাবলী নিজেরাও স্বচ্ছন্দে পালন করতে পারে এবং অপরকেও সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর এজন্যই সাহাবায়ে কেরাম আবিসিনীয়া বা হাবশায় হিজরত করেছিলেন। তারপর পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ মদীনায় হিজরত করেছিলেন। (তাফসীরে ইবনে কাসির, তাফসীরে কুরতুবী)।
বস্তুত হিজরতের পথে প্রথম বাঁধা হলো মৃত্যুভয়। স্বদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাবার মধ্যে মানুষ প্রথম যে সমস্যাটির সন্মুখীন হয় তা হলো নিজের প্রাণের আশঙ্কা। স্বদেশ ত্যাগ করে অন্যত্র রওয়ানা হলে পথিমধ্যে অবস্থিত স্থানীয় কাফেরদের সাথেও প্রাণঘাতি সংঘর্ষের আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে। এই আশঙ্কা একান্তই অমূলক ও ভিত্তিহীন। এর প্রতি দিকনির্দেশনা প্রদান করে মহান রাব্বুল আলামীন আল কোরআনে ঘোষণা করেছেন : জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী; তারপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা আল আনকাবুত : ৫৭)।
এই আয়াতে কারীমায় উপরোক্ত আশঙ্কার মূলোচ্ছেদ করা হয়েছে যে, জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেউ কোথাও মৃত্যুর কবল হতে কোনো অবস্থাতেই রেহাই পাবে না। সুতরাং মৃত্যুর ভয়ে কাতর হওয়া বা অস্থির হওয়া মুমিন মুসলমানের কাজ হতে পারে না। তাই, স্ব-স্থানে থাকা অথবা হিজরত করে অন্যত্র চলে যাওয়ার মধ্যে মৃত্যুর ভয় অন্তরায় না হওয়াই শ্রেয়। বিশেষ করে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের নির্দেশাবলী পালন করা অবস্থায় মৃত্যু আগমন করা চিরস্থায়ী সুখ, পরিত্রাণ ও নেয়ামতের কারণ। আখেরাতে এই সুখ লাভ করা যাবে এবং এই নেয়ামত ও পাওয়া যাবে। অতএব মরণশীল প্রাণের কথা ভেবে ঈমান সংরক্ষণ ও ন্যায়প্রতিষ্ঠা করনের সহজ পথ হিজরত থেকে পিছপা হওয়া মোটেই সঙ্গত নয়।
হিজরতের পথে দ্বিতীয় আশঙ্কা এই যে, ভিন দেশে গমন করার পর রুজী-রোজগারের ব্যবস্থা কি হবে? স্বদেশে বা জন্মস্থানে তো মানুষ কিছু পৈতৃক সম্পত্তি, কিছু নিজের উপার্জন দ্বারা জীবনধারণ ও বিষয়-সম্পত্তির দেখা শোনার ব্যবস্থা করে থাকে। হিজরতের সময় এগুলো সবই এখানে থেকে যাবে। কাজেই পরবর্তী পর্যায়ে জীবননির্বাহ কেমন করে হবে? মহান রাব্বুল আলামীন আল কোরআনে এই আশঙ্কার জওয়াব প্রদান করে ইরশাদ করেছেন : আর এমন অনেক জীবজন্তু রয়েছে যারা নিজেদের খাদ্য-সামগ্রী মজুদ রাখে না, আল্লাহই তাদেরকে ও তোমাদেরকে রিজিক দান করেন; আর তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। (সূরা আল আনকাবুত : ৬০)।
সুতরাং পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ও স্ব-উপার্জিত বস্তু সমূহকে রিজিকের প্রকৃত উপায়-উপকরণ মনে করা ভুল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই প্রকৃত রিজিক দাতা। তিনি ইচ্ছা করলে বাহ্যিক আয়োজন ছাড়াও রিজিক দান করেন। আর ইচ্ছা না করলে সকল আয়োজন থাকা সত্ত্বে ও মানুষ রিজিক থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে। এর প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন হাজারো জীব জন্তু রয়েছে যারা খাদ্য সঞ্চয় করার কোনো ব্যবস্থা করে না। কিন্তু আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা নিজ কৃপায় প্রত্যহ তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করেন। যেমন পক্ষীকুল সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে প্রত্যাবর্তন করে।
অথচ তাদের না আছে ক্ষেত-খামার না আছে জমা-জমি ও বিষয়-সম্পত্তি। তারা কোনো অফিস অথবা কারখানার কর্মচারীও নয়। তারা আল্লাহপাকের উন্মুক্ত পৃথিবীতে বিচরণ করে এবং উদরপূর্তি খাদ্য লাভ করে। সুতরাং উদরপূর্তি ও রুজি-রোজগারের আশঙ্কায় হিজরত না করা নিরেট বোকামী ছাড়া কিছুই নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।