Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধুলায় অতিষ্ট জনজীবন

গ্রিনসিটি চট্টগ্রাম এখন দূষিত নগরী : বাড়ছে রোগ-বালাই নির্বিকার সিটি কর্পোরেশন সিডিএ পরিবেশ অধিদপ্তর

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

সড়কে মাটি বালুর স্তূপ। তাতে চলছে যানবাহন। চারদিকে সমানে উড়ছে ধুলাবালু। গাড়ির দরজা-জানালা দিয়ে ঢুকছে ধুলা। আশপাশের দোকানপাট, বাসা বাড়িতে জমছে ধুলার আস্তর। পথচারীরা নাকে কাপড় গুঁজে চলাচল করছেন। কেউ লাগিয়েছেন মাস্ক। তাতেও রেহায় নেই। মাথা থেকে শুরু করে সারাগায়ে জমছে ধুলা। সড়কের পাশের খাবারের দোকানিরা দোকানের সামনে কিছুক্ষণ পর পর পানি ছিটাচ্ছেন। তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।
এমন বেহাল অবস্থা নগরীর বন্দর ফকিরহাট থেকে আগ্রাবাদ এলাকায়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে চট্টগ্রাম নগরীর এই প্রধান সড়কে। বিমানবন্দর থেকে আগ্রাবাদ হয়ে লালখান বাজার পর্যন্ত সড়কে এখন ধুলাবালুতে সয়লাব। পাইলিংয়ের জন্য তোলা মাটির স্তুপ সড়কজুড়ে। সেখান থেকে ধুলাবালু উড়ছে চারিদিকে। একই অবস্থা নগরীর আরও কয়েকটি সড়কে। উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়িমুক্ত সড়ক, উপ-সড়কও ধুলাবালু, ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব। উন্নয়নের জন্য সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে নগরীর অবস্থা বেহাল। তার ওপর পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। চরম হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
রাস্তা কেটে তাতে রাখা হচ্ছে মাটি, বালু। রাস্তায় বালু রেখেই চলছে কেনাবেচা। নির্বিচারে চলছে পাহাড় নিধন। সড়কে ধুলাবালুর সাথে হরেক বর্জ্য জমছে। বাতাসে উড়ছে ধুলা। তার সাথে যোগ হয়েছে যানবাহন, কল-কারখানা আর নগরীর আশপাশের ইটভাটার কালো ধোঁয়া। এতে চট্টগ্রামের বাতাস মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। এক সময়ের সবুজ নগরীর বাতাসে এখন বিষ। শ^াস নেওয়ার সাথে শরীরে ঢুকছে সেই বিষ। বিষাক্ত বাতাসে বাড়ছে অ্যাজমা, চর্মরোগ, শ^াসকষ্টসহ নানা রোগবালাই। ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমেই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। ধুলাবালুতে সবচেয়ে বেশি কাহিল শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ধুলাবালুর কারণে চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ ও নাকের অ্যালার্জি সমস্যা বেশি হচ্ছে। ধুলাবালুর সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও জীবাণু শরীরে ভেতর ঢুকে পড়ছে। তা রক্তের সঙ্গে মিশে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার সৃষ্টি হচ্ছে। শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহও বাড়ছে। অসংক্রামক রোগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বায়ু দূষণ।
বায়ু দূষণ নীরব ঘাতক হিসাবে কাজ করছে। অথচ নগরীকে দুষণমুক্ত করার দায়িত্ব যাদের তারা নির্বিকার। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ নগরীতে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নেয়া হয়েছে পরিবেশ ছাড়পত্র। কথা ছিল উন্নয়ন কাজে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে। যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে সেখানে প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও থাকবে। ধুলাবালু তাড়াতে দিনে একাধিকবার পানি ছিটানোর শর্তও জুড়ে দেয়া হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রে। কিন্তু এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিগত ২০১৯ সাল থেকে প্রধান সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। বর্ষায় কাদামাটির প্লাবন আর বৃষ্টি শেষ হতেই ধুলার যন্ত্রণায় অতিষ্ট সড়কের দুই পাশের লাখো মানুষ। মাঝে মধ্যে ধুলা তাড়াতে পানি ছেটানো হয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে মানুষের জীবন অতিষ্ট। সড়কের দুই পাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। বিশেষ করে হোটেল, রেস্তোরাঁর অবস্থা একেবারেই কাহিল। কোন অবস্থায় ধুলাবালু থেকে রেহাই মিলছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধুলার যন্ত্রণায় ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠার উপক্রম হয়েছে। ক্রেতারা পারতপক্ষে এসব এলাকা এড়িয়ে চলছেন।
নগরীতে চলছে সিডিএর পানিবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে নগরীর বিভিন্ন খাল, নালা সংস্কার করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগেও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নালা সংস্কার করা হচ্ছে। খাল, নালা থেকে মাটি তুলে রাখা হয়েছে সড়কের উপর। সেখান থেকে উড়ছে ধুলাবালু। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত থাকছে। নগরীর আরও কয়েকটি সড়কে উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। সেখানেও এমন বেহাল দশা। তবে সিডিএর কর্মকর্তারা দাবি করেন, তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিয়মিতম না হলেও ওইসব এলাকায় ধুলা কমাতে পানি ছিটানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার সুয়্যারেজ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে নগরীর ২০০ কিলোমিটার সড়ক কাটার ঘোষণা দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তখন পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একসময় পাহাড়ঘেরা এ নগরী ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নগরবাসী স্বাচ্ছন্দ্যে পথ চলতে পারতেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন পরিচ্ছন্ন নগরীর প্রশংসা করতেন। কিন্তু দিনে দিনে এ নগরী তার সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে। নির্বিচারে পাহাড় নিধন করা হচ্ছে। কাটা হচ্ছে সবুজ বৃক্ষ। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়ন এবং দখলবাজিতে খাল, ছরা, নালা, নর্দমা ও জলাশয় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে ছিল সবুজ পাহাড়, এখন সেখানে বিরানভূমি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর।
নগরীতে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত কল-কারখানা। বিশেষ করে রি-রোলিং মিলের কালো ধোঁয়ায় নগরীর বাতাস বিষিয়ে তুলেছে। তার সাথে যোগ হয়েছে নগরীর অদূরে গড়ে ওঠা অসংখ্য ইটভাটার কালো ধোঁয়া। লক্কর-ঝক্কর যানবাহন চলছে নগরীতে। এসব যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন বেহাল। সড়কেই পড়ে থাকছে ময়লা, আবর্জনা। এর ফলে নগরীর পরিবেশ মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে।
নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এজন্য বছরে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার সুফল মিলছে না। নগরীকে ধুলার দূষণমুক্ত করতে সুইপিং গাড়ি কেনা হয়। কিন্তু সেটিও অকেজো পড়ে রয়েছে। কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাসেম জানান, রাস্তায় ধুলার পরিমাণ এত বেশি ওই গাড়ি দিয়ে ধুলা তাড়াতে গেলে চারিদিকে ধুলা উড়তে থাকায় বায়ু দূষণ আরও বেড়ে যায়। তবে তিনি দাবি করেন, রাস্তা ধুলাবালিমুক্ত রাখতে নিয়মিত ঝাড়ু দেয়া হচ্ছে। পানি ছিটানোর কথা থাকলেও পানি সঙ্কটের কারণে তা নিয়মিত করা যাচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ^াস বলেন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে দেয়া পরিবেশ ছাড়পত্রে প্রকল্প এলাকাকে দূষণমুক্ত রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা অনেকে প্রতিপালন করছে না। এর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। এছাড়া যানবাহনের কালো ধোঁয়া, পাহাড় কাটা ও কল-কারখানার দূষণের বিরুদ্ধেও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষ করে বায়ু দূষণের ফলে রোগ-বালাই বাড়ছে জানিয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, বায়ু দূষণের ফলে অ্যাজমা, শ^াসকষ্ট, চোখের প্রদাহ এমনকি অন্ত্রেও প্রদাহ হচ্ছে। এ থেকে লিভার, কিডনি, ফুসফুস বিকল হওয়া এমনকি ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। যেসব শিশুরা হেঁটে কিংবা খোলা যানবাহনে যাতায়াত করছে তাদের নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক, অসুস্থ এবং শিশুদের অবস্থা বায়ু দূষণের ফলে নাজুক হয়ে পড়ছে। রাস্তার পাশে হোটেল, রেস্তোঁরায় খোলা খাবার খেয়ে লোকজন তাৎক্ষণিক ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানান পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
এদিকে হাসপাতালগুলোতে বায়ু দূষণজনিত রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ু দূষণ নীরব ঘাতক। এর ফলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ধুলাবালুর যন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষায় এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়মিত মাস্ক পরা, মাথায় ক্যাপ পরা এবং ফুলহাতা শাট পরার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। বাসায় ফিরে ভালো করে হাত-মুখ ধোঁয়া এবং পারলে গোসল করে ফেলার পরামর্শ তাদের। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ