বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, এই পৃথিবীতে বরকতের বিকাশ ঘটে দু’রকমে। প্রথমত : মূল বস্তুটি প্রকৃতভাবেই বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়া সম্পর্কেও আলোচনা করেছি। দ্বিতীয়ত : কোনো কোনো সময় মূল বস্তুতে বাহ্যত কোনো বরকত বা প্রবৃদ্ধি যদিও হয় না, পরিমাণে যা ছিল তাই থেকে যায়, কিন্তু তার দ্বারা এতবেশি কাজ হয়, যা এমন দ্বিগুণ, চারগুণ বস্তুর দ্বারাও সাধারণত সম্ভব হয় না। তাছাড়া সাধারণ ভাবেও দেখা যায় যে, কোনো একটা পাত্র, কাপড়-চোপড়, কিংবা ঘর-দুয়ার অথবা ঘরের অন্য কোনো আসবাবপত্র এমন বরকতময় হয় যে, মানুষ তাতে আজীবন উপকৃত হওয়ার পরেও তা তেমনি বিদ্যমান ও অবিকৃত থেকে যায়।
পক্ষান্তরে অনেক জিনিস তৈরি করার সময়ই ভেঙ্গে যায়, বিনষ্ট হয়ে যায় কিংবা অটুট থাকলেও তার দ্বারা উপকার লাভের কোনো সুযোগ আসে না। অথবা উপকারে আসলেও তাতে পরিপূর্ণ উপকৃত হওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। এই বরকত মানুষের ধন-সম্পদে হতে পারে, মন-মস্তিষ্কে হতে পারে, আবার কাজ-কর্মেও হতে পারে। কোনো কোনো সময় মাত্র এক গ্রাস খাদ্যও মানুষের জন্য পূর্ণ শক্তি-সামর্থের কারণ হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো সময় অতিউত্তম পুষ্টিকর খাদ্য-দ্রব্য বা ওষুধও কোনো উপকারে আসে না।
তেমনিভাবে কোনো সময়ের মধ্যে বরকত হলে মাত্র এক ঘণ্টা সময়ে এত অধিক কাজ করা যায়, যা অন্য সময় চার ঘণ্টায়ও করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে পরিমাণের দিক দিয়ে সম্পদ বা সময় বাড়ে না সত্য, কিন্তু এমনই বরকত তাতে প্রকাশ পায় যার ফলশ্রæতিতে কাজ হয় বহুগুণ বেশি। জীবন ও জগতের চলমান গতিধারায় এমন বরকতের আধিক্য বহুভাবেই মানুষ প্রত্যক্ষ করে। তাইতো সূরা আল আরাফের ৯৬ নং আয়াতে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন : ‘আর যদি সে জনপদের লোকেরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।
সুতরাং আমি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের বদলোতে পাকড়াও করেছি’। আলোচ্য আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে সহজেই বোঝা যায় যে, আসমান-জমিনের সমস্ত সৃষ্টি ও বস্তুরাজির বরকত ঈমান ও পরহেজগারীর ওপরই নির্ভরশীল। ঈমান ও পরহেজগারীর পথ অবলম্বন করলে আখেরাতের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার মঙ্গল, কল্যাণ এবং বরকত ও লাভ হয়।
পক্ষান্তরে ঈমান ও পরহেজগারী পরিহার করলে সেগুলোর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের চলমান অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করি, তাহলে এই বিষয়টি বাস্তব সত্য হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন বাহ্যিক দিক দিয়ে জমির উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক বেশি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যে, এখন মূলত ফল ও ফসলের মহাসমারোহ ও আয়োজন পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
তাছাড়া মানুষের ব্যবহারিক দ্রব্যের আধিক্য এবং নতুন নতুন আবিষ্কার এতবেশি যা পূর্ববর্তী বংশধরেরা ধারণা ও কল্পনা করতে ও পারেনি। কিন্তু এত সব বস্তুর ও উপকরণের প্রাচুর্য ও আধিক্য সত্তে¡ও আজকের মানুষকে একান্তই হতবুদ্ধি, চিন্তান্বিত, অভাবগ্রস্ত, রুগ্ন ও দারিদ্র পীড়িত দেখা যায়। দুনিয়ার কোথাও সুখ ও শান্তি কিংবা মানসিক শান্তি ও প্রশান্তির নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। অভাব-অনটন ও অসচ্ছলতার জোয়ার ধারা সর্বত্রই কম-বেশি বয়ে চলেছে। এর কারণ এছাড়া আর কি বলা যায় যে, বস্তু ও উপকরণ সবই আছে, এমন কি প্রচুর পরিমাণেই বর্তমান, কিন্তু এসবের বরকত শেষ হয়ে গেছে অথবা এগুলোতে বরকত নেই। (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন)।
বর্তমান যুগের মানুষ যারা অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসের পরে তাদের ভ‚সম্পত্তি ও ঘর-বাড়ির, সহায়-সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছে বা হবে, তাদেরকে শিক্ষণীয় সেসব অতীত ঘটনাবলী একথা বাতলে দেয়নি যে, কুফুরি ও অস্বীকৃতি এবং আল্লাহপাকের বিধানের বিরোধীতার পরিণতিতে যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তেমনিভাবে বর্তমানে উপস্থিত জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা ও পূর্ববর্তীদের অনুরূপ অপরাধে লিপ্ত থাকার ফলে তাদের ওপরও আল্লাহ তা’য়ালার আজাব ও গজব আপতিত হবে।
তারাও পূর্ববর্তী বেঈমান ও কাফেরদের মতো কালের করাল গ্রাসে বিস্তৃতির অতল গহŸরে হারিয়ে যাবে, যার প্রাথমিক নিদর্শন হচ্ছে জীবন ও জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট বস্তুরাজির বরকত ও কল্যাণ হারিয়ে যাওয়া। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ঈমান ও পরহেজগারীর পথ অবলম্বন করার এবং তার দেয়া বরকত লাভের তাওফীক এনায়েত করুন, এটাই আজকের একান্ত প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।