বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
রাসূলে আকরাম (সা.)-এর উত্তম আদর্শ ও শিক্ষার অর্থই হচ্ছে, কোনো আদর্শ সমাজের নমুনা। তাঁর শিক্ষা মানেই হচ্ছে পারস্পরিক একতা, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, ন্যায় ও কল্যাণের মৌলিক মূল্যবোধের শিক্ষা। উজ্জ্বল ঐতিহ্যের মহৎ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজের চেতনাকাঠামো নির্মাণ করেছেন। চরম হতাশাজনক ও ভেঙে পড়া একটি পরিবেশে আবির্ভূত হয়ে তিনি সমাজকে আবার গড়ে তুলেছেন। সামনে এগিয়েছেন তিনি একটি বিন্যস্ত পরিকল্পনা, চিন্তা ও কাজের একটি ছক, একটি নির্দিষ্ট পথনির্দেশনা এবং সর্বব্যাপী শুদ্ধির এক উজ্জ্বল ও সুগঠিত কর্মসূচি হাতে নিয়ে।
পৃথিবীকে দিয়েছেন একটি নতুন সমাজব্যবস্থা, নতুন চিন্তা ও উপলব্ধি এবং উপমাতুল্য একটি চেতনাকাঠামো। আর এভাবেই তিনি সমাজকে সতর্ক ও শুদ্ধ করেছেন। আর এই ব্যবস্থার নামই হচ্ছে ইসলাম। তাঁর আনীত এই দ্বীন মানুষের চেতনা ও কর্মপ্রয়াসের সব অঙ্গনকে এমন এক ঐক্যবদ্ধ কাঠামোতে নিয়ে আসে যে, তাতে এই দ্বীনের প্রত্যেক অনুসারীর মাঝে সৃষ্টি হয় অভিন্ন লক্ষ্য, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের অনুভূতি।
ভারসাম্য ও মধ্যপন্থার এক নিদর্শন এই দ্বীন, সময় ও যুগের চড়াই-উৎরাইয়ে যা কখনো মলিন হয় না; বরং এ দ্বীনের আলোকিত শিক্ষার বদৌলতে মানুষের সমাজ ও সামাজিক সংকটগুলোর সর্বোত্তম সমাধান বের হয়ে আসে। এ জন্যই এ দ্বীনকে বলা হয়ে থাকে দ্বীনে ফিতরাত বা স্বভাব-অনুকূল ধর্ম। এ দ্বীনের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সহজতা ও স্বাভাবিকত্ব; জটিলতা ও সংকীর্ণতা এতে অনুপস্থিত।
জাহেলিয়্যাত ও জাহালত-মূর্খত্ব ও মূর্খতার মাঝে ইসলাম একটি পরিষ্কার বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। ইসলাম স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, জাহেলিয়্যাত হচ্ছে বিশেষ ওই আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির নাম, যা মিথ্যা অহঙ্কার, গোত্রীয় আভিজাত্য ও প্রাধান্যের দ্বন্দ্ব, অন্ধ আবেগ ও চেতনা এবং প্রতিশোধ ও চরমপন্থার এক সমন্বিত রূপ। জাহেলিয়্যাত হচ্ছে শক্তিপূজারী একটি আচরণব্যবস্থা। এতে ধৈর্য ও পরমত সহিষ্ণুতা গণ্য হয় দুর্বলতা হিসেবে। বুদ্ধি ও মেধার ক্ষেত্রে উন্মাদনা এবং সংলাপের জায়গায় প্রতিশোধের আওয়াজ উচ্চকিত করা জাহেলিয়্যাতের নীতি।
রাসূলে আকরাম (সা.) ১৩ বছরের মক্কী জীবন কাটিয়েছেন সাহাবায়ে কেরামের তরবিয়ত ও জীবন গঠনের পেছনে। এরপর যখন জিহাদের হুকুম এলো তখনও এ নির্দেশনা প্রবল ছিল যে, সব শত্রুতা ও বৈরিতার মধ্যেও যেন ন্যায়ের নিশান হাতছাড়া না হয়। জিহাদ তো হচ্ছে হক্বের আওয়াজ ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, প্রতিশোধের নাম জিহাদ নয়। তাওহীদের মর্ম একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া, অপর ধর্মানুসারীদের প্রভুদের গালাগাল দেয়া নয়। মানবতার প্রতি সম্মান করার শিক্ষা দিয়েছেন নবীজী। নবীজীর শিক্ষায় বর্ণ, বংশ, ভাষা ও সম্পদের ভিত্তিতে কারো মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। মর্যাদা ও সম্মান নির্ধারিত হয় কেবল তাকওয়া, নেক আমল ও ন্যায়ানুগতার ভিত্তিতে। এটাই তাকওয়ার পথ।
নবীজীর মোবারক সীরাত মানুষকে অন্ধকার থেকে সরিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছে। নবীজীর মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা সাধিত হয়েছে এবং নবুওয়তের ধারা হয়েছে সমাপ্ত। আল্লাহ তাআলা আখেরী নবী ও আখেরী কিতাবের মাধ্যমে তার ‘হুজ্জত’ (প্রমাণ) চূড়ান্ত করেছেন। এখন হেদায়েতে ও গুমরাহির পথ স্পষ্টভাবে ভিন্ন, নেকি ও বদির মাঝে পার্থক্য পরিষ্কার। এখন আর নতুন কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।
রাসূলে রহমত (সা.)-এর পবিত্র সীরাত অধ্যয়নে এ অনস্বীকার্য বাস্তবতা সামনে চলে আসে যে, ইসলাম হচ্ছে নিরাপত্তার ঘোষক, সততার পতাকাবাহী এবং মানবতার বার্তাবাহক। মানবজাতির প্রতিটি সদস্যই ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্য ও সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। ইসলাম বর্ণ ও গোত্রের বিভাজনমালিন্য থেকে মুক্ত। মানবতার সব শ্রেণি ও স্তরের জন্য ইসলাম এসেছে রহমত স্বরূপ। অমুসলিম নাগরিকদেরও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি ইসলাম। ইসলামের দেয়া অধিকার ও মর্যাদায় অমুসলিমরা এতটাই সম্মানিত বোধ করে যে, পূর্বে এর কোনো নজির তারা পায়নি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।