বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেন, ‘জান্নাতবাসীদের মনে কোনো কারণেই কোনো দুঃখ থাকবে না; দুঃখ শুধু একটা কারণেই হবে, তা হলো পার্থিব জীবনের যে মুহূর্তগুলো তারা মহামহিমান্বিত আল্লাহপাকের স্মরণ থেকে উদাসীন ছিল’। (তবারানী-২০/৯৪)।
এখন প্রশ্ন, আমরা কীভাবে আল্লাহকে স্মরণ করতে পারি, যখন আমরা তাঁকে দেখতে সক্ষম নই; এবং তাঁর সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আমরা দৃশ্যায়িত করতে পারি না? এ বিষয়ে দু’টি উত্তর। প্রথম, আমরা তাঁর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি, কারণ সৃষ্টিসমূহই স্মরণ করিয়ে দেবে স্রষ্টাকে। সূরা আল ইমরান থেকে গৃহীত পূর্বোক্ত আয়াতে এ কথার উল্লেখ আছে; এবং আল কুরআনের বহু আয়াত এই একই কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
মহাবিশ্বের যে অকল্পনীয় বিশালতা, সেদিকে আমরা যত বেশি লক্ষ্য করব, তার নির্মাণকর্তা মহান আল্লাহর কথা তত বেশি মনে পড়বে। শুধু এইটুকু ভাবলেই শিহরিত হতে হয়, একটি বীজ অনঙ্কুরিত হতেও কত বিবিধ শক্তির একত্রভুত কী নিখুঁত সমন্বয়ই না প্রয়োজন! কীভাবে এই বিশাল মহাবিশ্ব জটিল কিন্তু পূর্ণ-ভারসাম্য নিয়ে ক্রমাগত স¤প্রসারিত হচ্ছে, আর কী নিখুঁত এই ব্যবস্থাপনা! এই মহাবিশ্বের প্রতি ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সরল ও জটিল যেখানে যা কিছু আছে, সবাই সর্বত্র স্রষ্টার অস্তিত্ব ও উপস্থিতির কথা ঘোষণা করছে।
বস্তুত, মহাবিশ্ব কথাটির আরবি প্রতিশব্দ ‘আলম’, যা মূল ‘ইলম’ বা জ্ঞান থেকে গৃহীত; এবং এ থেকে স্রষ্টাকে জানার বিষয়টি অনেকখানি অর্থময় হয়ে ওঠে। অনেকটা ‘খাতাম’ শব্দটির মতোই যার অর্থ মোহরাঙ্কিত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিমাসভ্যতা যখন বিজ্ঞানের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করল, তখন স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক ও সংযোগ, তা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আল কুরআন উল্লেখ করছে, ‘আকাশ ও জমিনে (আল্লাহর কুদরতের) কত (অসংখ্য) নিদর্শন রয়েছে, যার ওপর দিয়ে মানুষের গমনা-গমন, কিন্তু এতদসত্তে¡ও তারা কোনোরূপ মনোযোগ দেয় না’ (সূরা ইউসুফ : ১০৫)।
অতএব অদ্যকার মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের প্রধান কাজ হলো, স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের এই নির্বোধ সংযোগহীনতাকে দূর করা। আর এটাইতো প্রজ্ঞার প্রকৃত নিদর্শন যে, একজন ব্যক্তি মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করে এবং বলে সুবহানাল্লাহ, সকল মহিমা ও গৌরব একমাত্র আল্লাহর।
দ্বিতীয়ত, আমরা আমাদের জীবনে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের আশায় পুনঃপুন প্রার্থনা জানাই। এই প্রার্থনা, এই আকুতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মূল্যবান; কিন্তু এতদসঙ্গে সত্য ও বাস্তবতা হলো, আল্লাহর রহমত দ্বারা পূর্ণরূপে পরিবেষ্টিত এই জীবন তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া একটি মুহূর্তও চলতে পারে না। ঠিক এই মুহূর্তে কেউ হয়তো এই কথাগুলো পাঠ করছে। কিন্তু একটু বিরতি নিয়ে এ বিষয়ে আমরা একটু ভেবে দেখতে পারি।
মুদ্রিত অক্ষরগুলো শনাক্ত করতে চোখ সক্রিয় আছে, চোখে প্রতিফলিত কাগজের এই ছবিকে অর্থপূর্ণ বাক্যে রূপান্তরিত করার কাজে মস্তিষ্কও সক্রিয়; এবং এই কর্ম সম্পাদনের জন্য আমাদের মনের শান্তি ও একাগ্রতার সঙ্গে সময় ও প্রয়োজন, অথচ এর কোনোটাই আমাদের নিজস্ব নয়। তাহলে এগুলো আমরা কোথা থেকে পেলাম?
আমরা অধিকাংশই যথেষ্ট ভাগ্যবান যে, আমরা প্রতিদিনই আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য পাচ্ছি। এ বিষয়টিকেও আমরা আমাদের বিবেচনায় আনতে পারি। কারণ খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, আহারযোগ্য খাবার প্রস্তুতিকরণ, খাদ্যগ্রহণ, পরিপাকক্রিয়া ইত্যাদি মিলিয়ে আমাদের একগ্রাস খাবার মুখে তোলার মধ্যেও আল্লাহপাকের কী বিরাট রহমত যে বিদ্যমান, আমরাতো উপলব্ধি করতে পারি। এটাও প্রজ্ঞার পরিচায়ক যে, একজন ব্যক্তি এটা অনুভব করে এবং সকৃতজ্ঞচিত্তে বলে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’, সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর।
‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ এগুলো আল্লাহর যিকির-এর কিছু প্রচলিত ধরন। এগুলো উচ্চারণ করা মৌখিক যিকির; আর এগুলো অনুধাবন করা ও হৃদয়ে প্রতিফলন ঘটানো হলো অন্তরের যিকির। এই দু’টি ধরনই বিশেষভাবে মূল্যবান ও বাঞ্ছনীয়; এবং তারা একটি অপরটির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে। মৌখিকভাবে পুনঃপুন উচ্চারণের কারণে শব্দগুলি হৃদয়পটে গভীরভাবে খোদিত হয়, অপরদিকে আন্তরিক উপলব্ধি ও অনুভ‚তির প্রতিফলন মৌখিক উচ্চারণকে জীবন্ত ও প্রাণময় করে তোলে এবং উভয়ে একসঙ্গে একীভ‚ত হয়ে এই ইহজীবনের সফরকে এমনভাবে তাৎপর্যমÐিত করে তোলে, যা আমাদের দৃষ্টিকে প্রকৃত গন্তব্যের প্রতি তন্ময় ও সজাগ রাখতে সাহায্য করে।
এই যিকির আল্লাহপাকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে গভীর ও শক্তিশালী ও অবিচ্ছেদ্য করে তোলে; এবং ফলত, প্রবৃত্তির সকল অসৎ-অনুচিত আকর্ষণ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ হয়ে আমরা আমাদের হৃদয়ে নিবিড় প্রশান্তি অর্জন করতে পারি; এবং আমরা আশা করতে পারি, যে ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহপাকের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে, সময় যখন আসবে, সে বঞ্চিত হবে না।
একজন নিরক্ষর মেষপালক সঠিক উপলব্ধির মানদÐে একজন বিরাট মাপের মানুষ; এবং পার্থিব দৃষ্টিতে অনেক বড় বড় মানুষ যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল, আলোচ্য শিক্ষা-দীক্ষাহীন এই মেষপালকের তুলনায় তারা কতই না ক্ষুদ্র! অবশ্য বিষয়টি আমরা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।