Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারত থেকে ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ এলেও বাংলাদেশী যাত্রীবাহী নৌযানের পরীক্ষামূলক পরিচালনের ৪ বছর পরেও বানিজ্যিক যাত্রা অনিশ্চিত

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৪:০১ পিএম

ভারত থেকে বিলাসবহুল প্রমোদতরী ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ বাংলাদেশে ৬দিনের সফরে এলেও বাংলাদেশের যাত্রীবাহী নৌযানের পরীক্ষামূলক পরিচালন-এর ৪ বছর পরেও বানিজ্যিক কার্যক্রম আর শুরু করা যায়নি। বিষয়টির ভবিষ্যত নিয়ে রাষ্ট্রীয় জাহাজ চলাচল প্রতষ্ঠান-বিআইডব্লিউটিসি‘র দায়িত্বশীল সূত্রও কিছু বলতে পারেনি। ভারত-বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ও আন্তঃদেশীয় নৌ প্রটোকলের আওতায় ২০১৯-এর ২৯ মার্চ রাতে বিআইডব্লিউটিসি‘র যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি মধুমতি’ ঢাকা থেকে যাত্রা করে ৩০ মার্চ সকালে বরিশাল হয়ে পুরনো চালনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিনে সুন্দরবনের গহীনে ‘আংটিহারা’তে বাংলাদেশÑভারত নৌ সীমান্তে পৌছে। রাত্রী যাপন করে পরদিন কোলকাতার খিদিরপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। নৌযানটিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় এবং বিআইডব্লিউটিসি ও টিএ‘র একাধীক কর্মকর্তা ছাড়াও প্রায় ৮৫জন টিকেটধারী যাত্রী ভ্রমন করেছিলেন। সে সময় আংটিহারাতে দু দেশের কাষ্টমস ও ইমিগ্রেসন-এর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। পরিক্ষামূলক সে নৌযাত্রায় সমস্ত সমস্যা ও সম্ভবনা খতিয়ে দেখে বিআইডব্লিউটিসি’র পক্ষ থেকে মন্ত্রনালয়ে একটি সার-সংক্ষেপও প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ৪ বছর ধরে পুরো বিষয়টি অনিশ্চয়তার কবলেই আটকে আছে।
ঢাকা-বরিশালÑমোংলা-কোলকাতা রুটে পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালন শেষে এমভি মধুমতি এক সপ্তাহ পরে একই পথে ফিরে এলেও পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় আর কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।
ফলে প্রায় ৭০ বছর পরে দুই দেশের সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আন্তঃদেশীয় নৌপথে এ যাত্রীবাহী সার্ভিসের পরীক্ষামূলক পরিচালন-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হলেও তা মুখ থুবরে পড়ে আছে। সেসময়ে কোলকাতা থেকেও অনুরূপ একটি যাত্রীবাহী নৌযান বাংলাদেশে আসেছিল। এমনকি পরবর্তি সময়ে ভারত থেকে মোংলা-বরিশাল হয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকা সফরে ভারতীয় একাধিক পর্যটকবাহী নৌযান আসলেও বাংলাদেশ থেকে আর কোন নৌযান ভারতে যাবার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। এ ব্যপারে রোববার বিআইডব্লিউটিসি’র পরিচালক- বানিজ্য আশিকুজ্জামানের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কোন অগ্রগতির নেই বলেই জানান।
পরিক্ষামূলক ঐ যাত্রায় বিআইডব্লিউটিসি’র পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাত্রীও সংগ্রহ করা হয়েছিল। এমনকি সে সময়ে ‘খুব শিঘ্রই ঢাকা-কোলকাতা নৌপথে বানিজ্যিক ভিত্তিতে নৌযান পরিচালন শুরু হবে’ বলে জনান হলেও পরবর্তিতে অজ্ঞাত কারণেই বিষয়টি নিয়ে দাযিত্বশীল মহল নিশ্চুপ হয়ে যান। এমনকি ২০২০-এর মার্চে করোনা মহামারী শুরুর পরে পুরো কার্যক্রমই ভেস্তে যায়। তবে এ বিষয়টি অবশ্য দু দেশের পররাষ্ট্র ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে গত ১১ জানুয়ারী উত্তর প্রদেশের বারানসী’তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫১ দিনে ৩ হাজার ২শ কিলোমিটার নৌপথ ভ্রমনে ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’এর প্রমোদ ভ্রমনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার পরে শণিবার তা ভারত-বাংলাদেশের নৌ সীমান্তের আংটিহারা হয়ে মোংলাতে পৌছে। নৌযানটি ৮ ফেব্রুয়ারী বরিশালে পৌছে রাত্রীযাপনের পরে ঢাকায় যাবে। পরবর্তিতে পর্যটকবাহী নৌযনটি পদ্মা-যমুনা পাড়ি দিয়ে আসামে ডিব্রুগড়ে ৫১ দিনে নৌ ভ্রমন শেষ করবে। প্রায় ২শ ফুট লম্বা তিনতলা প্র্রমোদ তরীটি সুইজারল্যান্ড ও জার্মেনীর ২৮জন পর্যটক নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের ২৭টি নদী ও ৫০টি পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শন করবে। বিশে^র দীর্ঘতম এ নৌ ভ্রমনে খাবার সমতে প্রতি পর্যটকের কাছ থেকে ৫১ দিনে ১২ লাখ ৫৯ হাজার ভারতীয় রূপি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। যা বাংলাদেশী টাকায় ১৫ লাখ টাকারও বেশী।
১৮৭৪ সালে এ উপমহাদেশে বাস্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজ চালু করে বৃটিশ ‘আইজিএন’ এবং ‘আরএসএন কোম্পানী’। দেশ বিভাগের পরে ১৯৪৮ সালে ভারত-বাংলাদেশ নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে বৃটিশ-ভারতের ‘আইজিএন’ ও ‘আরএসএন কোম্পানী’র কয়লা নির্ভর বাস্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজের সাহায্যে বরিশাল থেকে কোলকাতা রুটে সরকারী যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান পরিচালিত হত। এছাড়াও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররের বড়ভাই-এর নৌযানও বরিশাল-কোলকাতা রুটে পরিচালিত হত। কিন্তু সুন্দরবনের গহীন অরন্যে তাদের একটি নৌযান ডুবির প্রেক্ষিত তা বন্ধ হয়ে যায়। বৃটিশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ‘ফ্লোটিলা নেভিগেশন’র নৌযানও এ নৌপথে যাত্রী পরিবহন করত দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত।
কিন্তু দেশ বিভাগের পরে এ সব স্টিমার সার্ভিসই বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নারায়নগঞ্জ ও বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত রকেট স্টিমারের সাথে কোলকাতা গামী ট্রেনের সংযোগ চালু ছিল ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত। নারায়নগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দমুখী স্টিমারের সাথেও কোলকাতা গামী ট্রেনের সংযোগ সার্ভিস চালু ছিল ঐ যুদ্ধপূর্ব সময় পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের আওতায় কোলকাতা থেকে আংটিহারা-মোংলা-বরিশাল হয়ে ভারতের আসামের ডিব্রুগর পর্যন্ত পণ্যবাহী নৌযানের চলাচল অব্যাহত রয়েছে।
২০১৯-এর ৩০ মার্চ ঢাকা-বরিশালÑকোলাকাতা রুটে এমভি মধুমতি নৌযানটি দিয়ে যে আন্তঃদেশীয় যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস পরিচালনা করা হয়, তাতে এ রুটে ভ্রমণকর বাদে দুই শয্যার ফ্যামিলি কেবিন বা ভিআইপি স্যুটের ভাড়া নির্ধারন করা হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা। প্রথম শ্রেণীর দুই শয্যার ভাড়া দশ হাজার এবং একক শয্যার কক্ষের ভাড়া ৫ হাজার নির্ধরিত ছিল। এর বাইরে ১৫% ভ্যাট ও ৫শ’ টাকা করে ভ্রমন করও পরিশোধ করতে হয়েছিল সব যাত্রীকে। যা ঢাকা-কোলকাতা-ঢাকা আকাশ পথে ভ্রমনের চেয়েও অনেক বেশী। ফলে সেসময় বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের তরফ থেকে আপত্তি ওঠে। ডেক ভাড়া নির্ধারন করা হয় দেড় হাজার টাকা। তবে ডেকের যাত্রীদের জন্য ভ্যাট না থাকলেও ভ্রমন কর ৫শ টাকা পরিশাধ করতে হয়েছিল।
২০১৫ সালে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সাড়ে ৭শ’ যাত্রী বহনক্ষম ৫.২৪৮ ফুট লাডেড ড্রাফটের দ্বিস্তর তলা বিশিষ্ট ‘এমভি মধুমতি’তে ২শ টন পণ্য পরিবহনেরও সুবিধা রয়েছে। জাপানের ইয়নমার ব্রান্ডের ১,১৮৪ অশ্বশক্তির দুটি করে মূল ইঞ্জিন সমৃদ্ধ এ নৌযানটি ঘন্টায় ১১ নটিক্যাল মাইল বা ২০.৩৭ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রমে সক্ষম বলে বিআইডব্লিউটিসির দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। তবে প্রায় ১২শ টন ওজনের ‘ইলেক্ট্রো-হাইড্রেলিক স্টিয়ারিং সিস্টেম’র অত্যাধুনিক ব্রীজ ইকুইপমেন্ট সম্বলিত ‘এমভি মধুমতি’ অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যায় ও যাত্রীবান্ধব না হওয়ায় তাতে ভ্রমনে এ পর্যন্ত যাত্রীদের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। প্রায় ৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৪-এর এপ্রিল এমভি বাঙালী ও ২০১৫-এর মে মাসে এমভি মধুমতি চালু হলেও ইতোমধ্যে তার পেছনে প্রায় ৩০ কোটি টাকা লোকশান গুনে গত দেড় বছর তা বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব নৌযান সরকার ও সংস্থাটির জন্য ইতোমধ্যে গলার কাটায়ও পরিনত পরিনত হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ