বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আমাদের প্রতিমুহূর্তের জীবনে ভাষা এক অনিবার্য অবলম্বন। জীবনের সকল কর্মপ্রবাহে বাহ্যত ভাষাই আমাদের প্রধান নির্ভরতা। পৃথিবীতে সব কিছুর বর্ণনার বাহন এ ভাষাই।
তাই ভাষা পৃথিবীতে মহান আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতগুলোর অন্যতম। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা আর রহমানে মানবতার প্রতি প্রদত্ত তাঁর শ্রেষ্ঠ নিয়ামতগুলোর উল্লেখ প্রসঙ্গে বর্ণনা শিক্ষা দেয়ার কথাটি উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : করুণাময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা। (সূরা আর রহমান : ১-৪)। দেখা যাচ্ছে যে, প্রধান প্রধান নিয়ামতগুলোর উল্লেখ প্রসঙ্গে তৃতীয় নম্বরে রয়েছে বর্ণনা শিক্ষা দেয়ার কথাটি। এ বর্ণনার বাহনই হচ্ছে ভাষা। ভাষা পৃথিবীতে একটি-দু’টি নয়, বিচিত্র ভাষার এই পৃথিবী। ভাষার এ বৈচিত্র্যও মহান আল্লাহর কুদরতের একটি নিদর্শন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে তোমাদের বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র্য’। এ বিচিত্র ভাষার মধ্যে আবার মাতৃভাষাই প্রত্যেকের স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তির বাহন এবং সবচে প্রিয় ভাষা।
আমাদের বাংলা ভাষার আদর্শ কবি ফররুখ আহমদ তো মাতৃভাষাকে খোদার সেরা দান বলেই উল্লেখ করেছেন। তিনি তার একটি কবিতায় বলেছেন : ‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা/ খোদার সেরা দান/ বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার/ রূপ যে অনির্বাণ’। পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির কাছে মহান আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য নবী-রাসূলদেরকেও নিজ নিজ মাতৃ ভাষায়ই প্রেরণ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত আমাদের সুপরিচিত। আয়াতটির অর্থ হল, ‘আমি প্রত্যেক নবী-রাসূলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি’।
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোনো জাতির কাছে বোধগম্যরূপে দীনের বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য মাতৃভাষা অপরিহার্য। সে কারণেই মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু তাই নয় মূসা (আ.)-এর বেলায় তো আমরা আরো স্পষ্ট একটি ব্যাপার লক্ষ করি। হযরত মূসাকে যখন ফেরাউনের কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছানোর আদেশ দেয়া হলো তখন তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বললেন : হে আল্লাহ, আমার বক্ষ আড়ষ্ট হয়ে আসছে এবং আমার কণ্ঠ সাবলীল নয়, অতএব আপনি হারুনের কাছেও ওহী প্রেরণ করুন। কারণ সে আমার চেয়ে স্পষ্টভাষী। (সূরা শুআরা ১৩)।
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাবলীল ভাষা একটি বড় সহায়ক শক্তি। কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো বার্তা মানব হৃদয়ে যথার্থরূপে পৌঁছে দেয়ার জন্য সাবলীল ভাষার গুরুত্ব কতটুকু তা এ আয়াত থেকেই অনুমিত হয়। সে কারণেই আখেরি নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে মহান আল্লাহ আরব-অনারবের সর্বোত্তম সাহিত্যমাধুর্য দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। নবীজি স্পষ্ট ভাষায় সে কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন। তাই বলা যায়, মাতৃভাষা আমাদের জীবনে যতটা পুষ্পিত হয়ে উঠবে ইসলামের আলোকময় বাণী আমরা তত সুন্দরভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব।
পূর্বের বক্তব্যে একথা প্রতীয়মান হয়েছে যে, নবী-রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় শুধু কথা বলার যোগ্যতাই দেয়া হয়নি; বরং বিশেষ ব্যুৎপত্তি দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। যাতে তাঁরা দীনের বার্তাগুলো যথাযথভাবে মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পারেন। বুঝা যায় যে, নবীগণ স্পষ্ট সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় মানুষের কাছে দীনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। প্রিয় নবীর হাদীসসমগ্রই আমাদের এ বক্তব্যের স্পষ্ট প্রমাণ দেয়। হাদীসের ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ভাব-সুষমা ও বাক্যের ছন্দময়তা এই আধুনিক কালেও আরবি সাহিত্যের এক প্রামাণ্য উৎস হয়ে আছে। যা সাহিত্যাপ্রেমীদেরও এক চমৎকার কৌতুহলের উৎস।
নবীদেরকে স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ সম্পর্কিত আয়াতটি উল্লেখ করে বিগত শতাব্দীর মহান চিন্তাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চিন্তাশীলগণ বুঝতে পারেন যে, স্বজাতির ভাষা বলতে শুধু স্বজাতির ভাষা বুঝতে পারা এবং তা অপরকে বোঝাতে পারার যোগ্যতা উদ্দেশ্য নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আপন যুগের ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চতর মানদ-ে উত্তীর্ণ হওয়া এবং তাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। মহান আল্লাহর উল্লেখিত বাণীর পরেই ‘যাতে আপনি তা তাঁদের জন্য সুস্পষ্টরূপে বিবৃত করতে পারেন’ কথাটিই আমাদের একথার সত্যায়ন করে। আপনারা জানেন যে, ইসলামের ইতিহাসে যে ব্যক্তিবর্গ বড় কোনো অবদান রেখেছেন এবং মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন তারা সাধারণত বাক ও লিখনি শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং তাঁদের রচনা ও বক্তৃতায় বিশুদ্ধ সাহিত্য ও অলঙ্কার বিদ্যমান’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।