বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
একবার নবী কারীম (সা.) স্বপ্নে দেখেছেন, তিনি সাহাবীদের নিয়ে নিরাপদে বাইতুল্লাহ প্রবেশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ‘হলক’ করেছেন। কেউ কেউ ‘কসর’ করেছেন। নবী (সা.) সাহাবীদেরকে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। সাহাবীগণ সাগ্রহে রওনা হলেন। কারণ ছয় বছর পর বাইতুল্লাহ জিয়ারতের সুযোগ এসেছে। নবীজি উট-বকরি সঙ্গে নিলেন এবং যুল হুলায়ফা নামক স্থানে গিয়ে উমরার ইহরাম বাঁধলেন।
মুসলমানদের খবর শুনে কুরাইশ ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়। মুসলমানদের বাধা দেওয়ার জন্য বাহিনী প্রেরণ করে। হুদায়বিয়া নামক স্থানে কুরাইশের একাধিক প্রতিনিধি নবীজির কাছে আসে। তিনি তাদেরকে এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আমরা উমরা পালনের জন্য এসেছি, যুদ্ধ করতে আসিনি। উমরা করে আমরা চলে যাব। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার জন্য তিনি উসমান (রা.) কে মক্কা প্রেরণ করেন। উসমান (রা.) কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে মুসলিমদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন।
এদিকে উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় নবী (সা.) সাহাবীদেরকে অবিচলতার সাথে যুদ্ধ করা, প্রয়োজনে জীবন দেওয়া, এ মর্মে তাঁর কাছে বাইআত হওয়ার আদেশ করেন। সাহাবীগণ তাঁর নির্দেশমতো বাইআত হন। (দ্র. তাফসীরে তাবারী ২১/৩১৬; সহীহ বুখারী : ৪১৫১-৫২)।
এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, সাহাবীগণ নবীজীর আদেশকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতেন এবং তাঁর নির্দেশ মানার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতেন। এখানে আমরা দেখেছি, যুদ্ধ করার জন্য সাহাবীদের মানসিক, সামরিক কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিলো না। তাঁরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে আসেননি। তাছাড়া তাঁদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ বা ১৫ শ’। যুদ্ধসামগ্রীও তেমন ছিলো না। উপরন্তু তাঁরা নিজেদের আবাসভ‚মি থেকে অনেক দূরে ছিলেন। পক্ষান্তরে শত্রæপক্ষ ছিলো আপন নগরীতে। এমন অসম পরিস্থিতিতেও তাঁরা নবীজির হাতে হাত রেখে যুদ্ধের শপথ গ্রহণ করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) মক্কায় সফরে ছিলেন। পথে এক বেদুঈনের সাথে দেখা হলো। তিনি লোকটিকে আগে বেড়ে সালাম দিলেন। নিজের সওয়ারীর উপর তুলে নিলেন এবং পরিধানের পাগড়িটা হাদিয়া দিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে দিনার সাহাবীর এই আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, এরা বেদুঈন। সামান্য কিছু পেলেই খুশি হয়ে যায়।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বললেন, তার পিতা আমার পিতার বন্ধু ছিলো। আর আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, পিতার বন্ধুর সাথে সদাচার করা পুত্রের জন্য বড় সওয়াবের কাজ। (সহীহ মুসলিম : ২৫৫২)। মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচার অত্যন্ত জরুরি। নবীজি এ ব্যাপারে জোর তাকিদ করেছেন। পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সদাচারের শিক্ষাও তিনি দিয়েছেন। এ শিক্ষা সাহাবী কত গভীরভাবে হৃদয়ে ধারণ করেছেন তা আমরা দেখলাম। সফরে পিতার এক বেদুঈন বন্ধুর ছেলেকে পেয়ে নিজের সওয়ারীর উপর তুলে নিয়েছেন এবং পরিধানের পাগড়ি উপহার দিয়েছেন। অথচ তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী ছিলেন।
একদিন নবী (সা.) আবুল হায়ছাম (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি কোনো খাদেম আছে? তিনি বললেন, জী না। নবীজি বললেন, আমার কাছে যুদ্ধবন্দী এলে তুমি এসো। এরপর নবীজির কাছে দুইজন যুদ্ধবন্দী এলো। আবুল হায়ছাম (রা.) নবীজির কাছে গেলেন। নবীজি বললেন, দুইজনের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ হয় নিয়ে নাও।
তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি পছন্দ করে দিন। নবী (সা.) একজনের দিকে ইশারা করে বললেন, তাকে নিয়ে যাও, আমি তাকে নামাজ পড়তে দেখেছি আর তুমি তার সাথে সুন্দর ব্যবহার করো। গোলাম নিয়ে আবুল হায়ছাম (রা.) বাড়ি গেলেন এবং স্ত্রীকে নবীজির ওসিয়ত সম্পর্কে অবহিত করলেন। স্ত্রী বললেন, নবী (সা.) গোলামের ব্যাপারে যে ওসিয়ত করেছেন তা পালন করার একমাত্র পথ হলো তাকে আযাদ করে দেওয়া। আবুল হায়ছাম (রা.) বললেন, তাহলে সে আযাদ। (জামে তিরমিজি : ২৩৬৯)।
নবীজি আবুল হায়ছাম (রা.) কে গোলামের সাথে সদাচারের ওসিয়ত করেছেন, আযাদ করতে বলেননি। কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমতী স্ত্রী চিন্তা করেছেন, গোলাম আমাদের মালিকানায় থাকলে হয়তো আমরা তার সাথে যথাযথ সুন্দর আচরণ করতে পারব না। নবীজির ওসিয়ত সুচারুরূপে পালন করার একমাত্র পথ হলো তাকে আযাদ করে দেওয়া। এ কথা শুনে আবুল হায়ছাম (রা.) আর দেরি করলেন না, সঙ্গে সঙ্গে তাকে আযাদ করে দিলেন। সাহাবীদের বৈশিষ্ট্য এটাই, তাঁরা নবীজির নির্দেশ অনুযায়ী উত্তমভাবে আমল করতেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।