বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ জাল্লা শানুহু কুরআনুল কারীমে ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করে ইরশাদ করেছেন : যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে। (সূরা আল বাকারাহ : ৩)। এই আয়াতে কারীমায় মুমিন মুত্তাকীদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, তারাই মুমিন মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত, যারা গায়েব বা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনে বা বিশ্বাস স্থাপন করে। এখানে দু’টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। একটি হলো ঈমান এবং অপরটি হলো গায়েব। সুতরাং এই দু’টি শব্দের অর্থ ও মর্ম বিশ্লেষণ করলে ‘ঈমান বিল গায়েবের’ পরিচয় লাভ করা সহজতর হবে। আসুন, এবার সেদিকে নজর দেয়া যাক।
আরবি ঈমান শব্দের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘কোন বিষয়ের স্বীকৃতি দেয়া।’ ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান বলতে বোঝায়, ‘কোনো বিষয়ে মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে অন্তরে দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করা এবং তা কাজে পরিণত করা।’ এখানে ঈমানের তিনটি দিক উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথমত, অন্তরে অকপটচিত্তে দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করা। দ্বিতীয়ত, সে বিষয়ের স্বীকৃতি মুখে প্রদান করা। তৃতীয়ত, কর্মকাÐের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন করা। মনে রাখা দরকার যে, শুধু বিশ্বাসের নামই ঈমান নয়।
কেননা স্বয়ং ইবলিস, ফেরাউন, নমরূদ এবং অনেক কাফেরও মনে মনে বিশ্বাস করত। কিন্তু আদেশ-নিষেধ না মানার কারণে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। অনুরূপভাবে শুধু মুখে স্বীকৃতি দেয়ার নামও ঈমান নয়। কারণ মুনাফিকরা মুখে স্বীকৃতি দিত বা দেয়। মূলত ঈমান হচ্ছে জানা এবং মানার সমষ্টি। অন্তরে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেয়া এবং তা কার্যে পরিণত করাÑ এ তিনটির সমষ্টির নাম হচ্ছে ঈমান। অবস্থা ভেদে ঈমান বাড়ে এবং কমে।
আর আরবি গায়েব শব্দের অর্থ হচ্ছে, ‘এমন সব বস্তু যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে এবং যা মানুষ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘ্রাণ নিতে পারে না, জিহŸা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না, ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করতে সক্ষম হয় না।’ (তফসীরে ইবনে কাসির; আল বাহরুল মুহীত)।
বস্তুত আল কুরআনে ‘গায়েব’ শব্দ দ্বারা যে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে, ‘সেগুলোর সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রদান করেছেন এবং মানুষ সে সকল বিষয়ে নিজ বুদ্ধি বলে ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম।’ আলোচ্য আয়াতে ‘গায়েব’ শব্দ দ্বারা আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তা, সিকাত বা গুণাবলি এবং তাকদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থা, কেয়ামত এবং কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফিরিশতাকুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণের বিস্তারিত বিষয়কে বোঝানো হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে ঈমান বিল গায়েব অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ পাকের নিকট হতে যে হেদায়েত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, সেসবগুলো আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া, মৌখিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা ও কর্মের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা। (তাফসীরে ইবনে কাসির)।
হাদিস শরীফে ঈমান বিল গায়েব-এর বহু উদাহরণ রয়েছে। এতদ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন : গায়েবের বিষয়াদির ওপর ঈমান আনার চেয়ে উত্তম ঈমান আর কারও হতে পারে না। তারপর তিনি সূরা আল বাক্বারাহ-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। (মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/২৬০)।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী আবু উবাইদাহ ইবকুল জাররাহ (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে জিহাদ করেছি, আমাদের থেকে কেউ কি উত্তম আছে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : হ্যাঁ, তারা তোমাদের পরে এমন এক জাতি, যারা আমাকে না দেখে আমার ওপর ঈমান আনয়ন করবে। (সুনানে দারমী : ২/৩০৮; মুস্তাদরাকে হাকেম : ৪/৮৫)।
বস্তত সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনদের থেকে বর্ণিত বিভিন্ন বর্ণনায় ঈমান বিল গায়েব-এর বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। কেউ বলেছেন ঈমান বিল গায়েব-এর উদাহরণ হলো ‘আল কুরআন’। আবার কেউ বলেছেন ‘জান্নাত ও জাহান্নাম।’ এ সবগুলোই হলো ঈমান বিল গায়েবের উদাহরণ। মূলত ঈমানের ছয়টি রুকন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি ঈমান বিল গায়েবের মূল অংশ। (আত্ তাফসীরুস সহীহ : পৃ :৯৯)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।