Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিদ্বেষ ছড়ালেও কেন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না বিজেপি?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৯ পিএম

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ভোপাল থেকে নির্বাচিত এমপি প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর আবারও মুসলিম-বিদ্বেষী হেইট স্পিচ দিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছেন – কিন্তু তার দল তো নয়ই, পার্লামেন্টের স্পিকারও তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেননি।

সম্প্রতি কর্নাটকের শিভামোগায় হিন্দুদের একটি ধর্মীয় সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে এই ‘সন্ন্যাসিনী’ পার্লামেন্টারিয়ান বলেছিলেন, জিহাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হিন্দুদের ঘরে ঘরে হাতিয়ার তৈরি রাখতে হবে, অস্ত্রে শান দিতে হবে। এই ঘটনার দিনকয়েক পরে কর্নাটক পুলিশ তার বিরুদ্ধে একটি রুটিন এফআইআর করেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে কোন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রজ্ঞা ঠাকুরও সারা দেশে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, নানা সভায় যোগ দিচ্ছেন।

বিজেপির এই বিতর্কিত এমপি “রোজ যেভাবে নিয়ম করে বিষ ছড়াচ্ছেন”, তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের শতাধিক সাবেক শীর্ষস্থানীয় আমলা শনিবার (৭ জানুয়ারি) লোকসভার স্পিকার ও এথিকস কমিটির কাছে একটি খোলা চিঠিও লিখেছেন। ওই চিঠিতে তারা লিখেছেন, “নিয়মিত উসকানিমূলক হেইট স্পিচ আর বারবার ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যমে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর দেশের পার্লামেন্টের সদস্য থাকার নৈতিক অধিকার খুইয়েছেন বলে আমরা মনে করি।”

এই চিঠিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মধু ভান্ডারী, সাবেক কেন্দ্রীয় সচিব অনিতা অগ্নিহোত্রী বা রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্য সচিব সালাউদ্দিন আহমেদের মতো বহু পরিচিত নাম রয়েছে। তবে ঘটনা হল, এর আগেও বহু সিভিল সোসাইটি গ্রুপ পার্লামেন্টে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের সদস্যপদ বাতিল করার দাবি জানিয়েছে, কিন্তু স্পিকারের কার্যালয় বা দল হিসেবে বিজেপি তাতে কর্ণপাতও করেনি।

২০১৯ সালে ভারতের জাতির জনক মোহনদাস গাঁধীর হত্যাকারী নাথুরাম গোডসেকে ‘সাচ্চা দেশপ্রেমী’ বলেও বর্ণনা করেছিলেন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, যার পর প্রধানমন্ত্রী মোদী এক টিভি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন, “আমি এর জন্য কখনও ওনাকে মন থেকে মাফ করতে পারব না।”তবে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকাশ্য তিরস্কারের পরও প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে বিজেপি কোন ব্যবস্থাই নেয়নি, বরং তাকে পার্লামেন্টে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়েছে।

বিজেপির এই এমপি-র যে ভাষণকে ঘিরে এই সবশেষ বিতর্ক, তাতে তিনি একবারও ‘মুসলিম’ কথাটি উচ্চারণ করেননি – কিন্তু কাদের নিশানা করে কথাগুলো বলেছিলেন তা বুঝে নিতে কোন অসুবিধা হয় না। শিভামোগার ওই হিন্দু সমাবেশের যে ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর বলছেন, “ওদের বরাবরই একটা জিহাদের ট্র্যাডিশন আছে। কিছু না-হলে লাভ জিহাদ-ই সই। আর সে জন্য আমাদের হিন্দুদের বাড়ির মেয়েদের রক্ষা করতে হবে।” এরপরই তিনি উপায় বাতলে দিয়েছেন হিন্দুদের বাড়ির মেয়েদের রক্ষা করার জন্য কী করতে হবে।

তিনি বলেন, “হিন্দুদের বাড়িতে অস্ত্র তৈরি রাখতে হবে। কিছু না-পেলে বাড়িতে শাকসব্জি কাটার জন্য যে ছুরি থাকে, সেটাই হাতের কাছে রাখুন। অস্ত্রে শান দিয়ে রাখুন।”“কারণ কেউ জানে না কখন কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে তৈরি থাকতে হবে। আর আত্মরক্ষা করার অধিকার সবারই আছে এটা মনে রাখতে হবে”, বলেন তিনি। হিন্দুদের ঘরে ঘরে নিয়মিত পূজাপাঠ, ধর্মাচরণের মাধ্যমে নিজস্ব মূল্যবোধ ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২৬ ডিসেম্বরের এই সভার ভাষণ নিমেষে ছড়িয়ে পড়লেও কর্নাটকের বিজেপি সরকার দিন-তিনেক হাত গুটিয়েই ছিল, কোন ব্যবস্থা নেয়নি। পরে এই ভাষণ নিয়ে হইচই শুরু হলে পুলিশ একটি এফআইআর করেছে ঠিকই, তবে তাতে এখনও কোন চার্জশিট পেশ করা হয়নি।

৫২ বছর বয়সী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ও বিজেপি-র নেতাকর্মীদের কাছে ‘সাধ্বী প্রজ্ঞা’ নামেই বেশি পরিচিত। সাধ্বী বা সন্ন্যাসিনীদের মতো তিনি সব সময় গেরুয়া পোশাক পরেন, ছোট করে চুল ছাঁটেন। মধ্যপ্রদেশের ভিন্দে জন্মানো প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর কলেজজীবন থেকেই সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বাবাও ছিলেন আরএসএসের কর্মী।

১৯৯৭-এর পর তিনি এবিভিপি ছেড়ে ‘হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’ বা ‘দুর্গাবাহিনী’র মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যাদের সাধারণভাবে বিজেপির ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়। বজরং দলেরই মহিলা শাখার নাম দুর্গাবাহিনী। মোটরবাইকের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বরাবরের। সংগঠনের কাজে তিনি যেখানে সম্ভব, সেখানে মোটরবাইক চালিয়ে যেতেই ভালবাসতেন। ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওতে বোমা বিস্ফোরণে অনেকে হতাহত হওয়ার পর সেই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে সাধ্বী প্রজ্ঞার নাম উঠে আসে।

ঘটনাস্থলে বিস্ফোরক-বোঝাই যে মোটরবাইকটি পাওয়া গিয়েছিল, সেটি তার নামেই রেজিস্ট্রি করা ছিল। সেই সূত্র ধরেই তদন্তকারীরা মালেগাঁও বিস্ফোরণ কেসে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করেন। পরে বিজেপি আমলে ২০১৭ সালে ভারতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো গুরুতর চার্জ প্রত্যাহার করে নিলে বোম্বে হাইকোর্ট স্বাস্থ্যগত কারণে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের জামিন মঞ্জুর করে। মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলার আসামি হলেও তিনি এখনও জামিনেই আছেন – আর জামিনে থাকাকালীন অবস্থাতেই ভোটে জিতে পার্লামেন্টে গেছেন।

গত বছর জুলাই মাসে একটি ভিডিওতে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে বাস্কেটবল খেলতে দেখা গিয়েছিল। বিরোধী কংগ্রেস এরপর প্রশ্ন তোলে, স্বাস্থ্যের কারণে জামিন পাওয়া একজন আসামি কীভাবে বাইরে খেলাধূলো করে বেড়াতে পারেন? ২০১৯-এ ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি সিটিং এমপিকে বসিয়ে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে গুরুত্বপূর্ণ ভোপাল আসন থেকে প্রার্থী করেছিল, আর তিনি জিতেওছিলেন প্রায় পৌনে চার লক্ষ ভোটের বিপুল ব্যবধানে।

ফরাসি ভারততত্ত্ববিদ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিশ্লেষক ক্রিস্টোফ জাফরেলোঁ এরপর বলেছিলেন, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর কার্যত ২০১৯ নির্বাচনের প্রতীকে (‘সিম্বল’) পরিণত হয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে প্রার্থী করা এবং তার লোকসভায় জিতে আসার মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের তথাকথিত ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’রাই হিন্দুত্ব রাজনীতির মূল ধারায় (মেইনস্ট্রিম) চলে এসেছিল।

পরবর্তী চার বছরে এটাও বারবার দেখা গেছে যে প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর যা-ই বলুন বা করুন, সেটা বিজেপির ঘোষিত অবস্থানের বিরুদ্ধে হলেও, দল তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই নেয়নি, বরং তিনি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় পেয়েছেন। ভারতের নামী সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “প্রজ্ঞা সিংয়ের বিরুদ্ধে বিজেপি কখনওই ব্যবস্থা নেবে না কারণ তারা মনে করে তিনি হলেন কংগ্রেসের তথাকথিত হিন্দু-বিদ্বেষ ফাঁস করে দেওয়ার সেরা হাতিয়ার।”

“একজন হিন্দু সন্ন্যাসিনীকে কংগ্রেস সন্ত্রাসের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছিল – কিন্তু তিনি মানুষের ভোটে জিতে এবং কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংয়ের মতো নেতাকে হারিয়ে পার্লামেন্টে এসেছেন, এটা দেখানোর জন্য প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে তারা সমর্থন দিয়েই যাবে,” বলছিলেন তিনি। সারদেশাই আরও জানাচ্ছেন, ভোপাল থেকে কংগ্রেস দিগ্বিজয় সিংকে প্রার্থী করছে, এটা জানার সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপির তৎকালীন সভাপতি (ও দেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) অমিত শাহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তার বিরুদ্ধে দল সাধ্বী প্রজ্ঞাকেই টিকিট দেবে।

‘অরুণ জেটলি আমাকে পরে বলেছিলেন শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটাররা বিরূপ হতে পারে এই আশঙ্কায় দলের অনেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু অমিত শাহর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত টিঁকে যায়,’ বলছিলেন রাজদীপ সারদেশাই। যখনই বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের তাস খেলার প্রয়োজন হয়, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মতো নেতা-নেত্রীরাই যে দলের সেরা বাজি তা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও একমত। তারা বলছেন, এ কারণেই বারেবারে ধর্মীয় উসকানি ও হেইট স্পিচ দিয়েও তিনি বহাল তবিয়তে এমপি রয়েছেন। সূত্র: বিবিসি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ