বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
কিছুদিন আগে একটি ওয়াজ-মাহফিলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পল্লি গাঁয়ের ছোট মাহফিল এবং সময়টা ছিল আসরের পর। তাই হাজিরীনের সংখ্যা বেশি ছিল না। গ্রাম দেশের মাহফিল সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে জমতে থাকে এবং রাত যত গভীর হয় মাহফিলও তত জমজমাট হয়ে ওঠে।
একজন তরুণ আলিম ওয়াজ করছিলেন। কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস শরীফের উদ্ধৃতির পাশাপাশি উর্দূ-ফার্সি বয়েতও পাঠ করছিলেন। সুতরাং ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি তিনি যে সুমধুর ওয়াজেরও একজন রসিক সমঝদার তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। আমরা একটূ দূরে ছিলাম তবে ওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। ওয়াজের মাঝে তিনি বিক্ষিপ্ত লোকজনকে শামিয়ানার নীচে আসারও আহ্বান জানাচ্ছিলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে যখন তিনি সূরা ত্বহার ১২৪ নম্বর আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন তখন আমরা জিবে কামড় দিলাম।
আয়াতের তরজমা : আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জীবন হবে বড় সঙ্কটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাব অন্ধ করে। সে বলবে, হে রব! তুমি আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চক্ষুসমান ছিলাম! আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে। যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে ও নিজ প্রতিপালকের নিদর্শনাবলিতে ঈমান আনে না তাকে আমি এভাবেই শাস্তি দেই। আর আখেরাতের আজাব বাস্তবিকই বেশি কঠিন ও অধিকতর স্থায়ী। (সূরা ত্বহা : ১২৪-১২৭)।
তার বক্তব্যের খোলাছা ছিল, যারা এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছেন, চা-স্টলে ও দোকানপাটে বসে আছে তারা যেহেতু ওয়াজ-মাহফিলের শামিয়ানার নিচে এসে বসেননি তাই উপরোক্ত আয়াত তাদের সম্পর্কে প্রয়োগ করা যায়। (নাউযুবিল্লাহ!) অথচ সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যায়, আয়াতটিতে বলা হয়েছে কাফেরদের অবস্থা, যারা কুরআন মজীদের প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করে এবং নবী (সা.) কে অস্বীকার করে। বলাবাহুল্য, যে কোনো ওয়াজ-মাহফিলে শামিয়ানার নিচে না আসার অর্থ কুরআন-হাদীসের প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন নয়, এমনকি তা ওই ওয়াজ মাহফিলের প্রতিও বিমুখতার দলিল নয়।
কারণ হতে পারে, ঐ ব্যক্তি এখন ব্যস্ত, কিছুক্ষণ পরে আসবে, কিংবা শামিয়ানার নিচে না আসলেও যেহেতু মাইকের আওয়াজ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাই নিজের জায়গায় বসে সে ওয়াজ শুনছে। যদি এগুলোর কোনোটাই না হয়, কেউ যদি ঐ বিশেষ মাহফিলের প্রতি বিমুখ হয়েই শামিয়ানার নিচে না আসে তবুও কি একে কুরআন-সুন্নাহর প্রতি বিমুখতা বলা যাবে? যাবে না।
কারণ হতে পারে ওই মাহফিলে যিনি ওয়াজ করছেন তার প্রতি ওই ব্যক্তির আস্থা নেই। বক্তা কুরআন-হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা করছেন এই আস্থা না থাকলে তিনি আসবেন কেন? তেমনি মাহফিলের ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে তার কোনো আপত্তি থাকতে পারে, যে কারণে তিনি এখানে আসেননি। মোটকথা, এমন হতে পারে যে, এই বিশেষ মাহফিল থেকে বিমুখ হলেও তিনি কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিমুখ নন।
তো মাহফিলের আওয়াজ যতদূর পর্যন্ত যাবে সবাইকেই শামিয়ানার নিচে আসতে হবে নতুবা তারা উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে পড়ে যাবেন, এটা কখনো ঠিক নয়। এ জাতীয় অসতর্কতা খুবই মারাত্মক। অনেক সময় তা সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত ও হঠধর্মী করে তোলে এবং তাদের দ্বীন ও ঈমানের ক্ষতির কারণ হয়ে যায়।
তো আমাদের নবীন আলেম ও তালিবে ইলমদের অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। জুমার আলোচনায় বা ওয়াজ-নসীহতে কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস শরীফ পাঠ করার অভ্যাস যেমন করা চাই; তেমনি সাবধানতাও অবলম্বন করা চাই। আলোচনায় কোন কোন আয়াত এবং কোন কোন হাদীস পাঠ করা হবে তা নির্ধারণ করে তার অর্থ ও মর্ম ভালোভাবে দেখে নেওয়া জরুরি।
কুরআন মজীদ খুলে আয়াতটির পূর্বাপর মনোযোগের সাথে পাঠ করলে এবং কোনো সহজ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাব থেকে আয়াতের অর্থ, মর্ম ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি দেখে নিলে ইনশা আল্লাহ এ ধরনের ভুল হবে না। এই সাবধানতাটুকু না থাকলে অজান্তেই আল্লাহ না করুন-কুরআন মজীদের তাহরীফে মা’নবী বা অর্থ-বিকৃতির মতো মারাত্মক গুনায় লিপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। অন্যান্য কুফল তো আছেই। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হেফাজত করুন এবং তওফীক দান করুন। আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।