প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
লম্বা করিডোর পেরিয়ে পাঁচ নম্বর স্টুডিওতে ঢুকলো রুমানা। সাথে এলেন অনুষ্ঠান প্রযোজক হায়দার।
মেজো মামার বন্ধু।
নাঃ একটুও বুক কাঁপছে না ওর। আর বুক কাঁপবেই বা কেন?
প্রাদেশিক সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম পুরস্কার পাওয়া মেয়ের ভয় না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আর এটাতো বেতার ভবনের এক নিভৃত হিম হিম কক্ষে বসে আধখানা গান গাওয়া। ‘অডিশন’ এর নামে একটা অফিসিয়াল কর্তব্য সারা।
নইলে এর কোন প্রয়োজনই ছিল না। অন্তত রুমানার মতো সঙ্গীত শিল্পীর জন্য তো নয়ই। মেজো মামার বন্ধু হায়দার বলে, অডিশন ছাড়াও শ্রোতারা তোমাকে লুফে নেবে।
তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও অফিসিয়াল নিয়ম একটা আমাদের মেনে চলতে হয়।
আপত্তি করবার অথবা ভাবনার কোনো অবকাশ নেই এতে। সবাই জানে রুমানাকে। জানে ওর বিশ্বাস আর ক্ষমতাকে।
রুমানার মধুক্ষরা কণ্ঠ নিঃসৃত সুরসুধায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সঙ্গীত সম্মেলনের যে হাজার হাজার সুর-পিয়াসী, তারা তো এদেশেরই মানুষ। এদেশের অগনিত জনসাধারণের প্রতিভূ হয়ে এসেছিল তারা। আর সেই সব মানুষের মধ্যেই তো সমগ্র দেশবাসীর অভিনন্দন পেয়েছে রুমানা।
পেয়েছে আশীর্বাদ। আর-না থাক। আর কোনো ভাবনার প্রয়োজন নেই তার। মেজো মামা ডিউটি রুমে রইলেন।
হায়দারের সাথে স্টুডিওর মোটা কার্পেটে এসে বসলো রুমানা। চারদিকে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র। সামনে মাইক। তানপুরাটায় হাত রেখে হায়দারের মুখের দিকে তাকালো রুমানা। হায়দার বলল, ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি কন্ট্রোলরুমে আছি।
মৃদু হেসে চোখ নামালো রুমানা।
হায়দার মামাটা যেন কি? ভয় পাবার মেয়ে নাকি সে।
সামনের এক টুকরো কাঁচের দেয়ালের ওপাশেই কন্ট্রোল রুম। বেশ কয়েকজন সঙ্গীত পরিচালক রয়েছেন ওখানে। হায়দার মামাও দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে।
‘অন এয়ার’ এর বাতিটা জ্বলতেই সুর ধরলো। একটা মসৃণ ঝংকারের সাথে একাকার হয়ে গেল রুমানার সুরেলা কণ্ঠস্বর। প্রথম সুর ধরার আমেজটা কাটতেই স্বাভাবিকভাবে চোখ খুলে সামনের দিকে তাকালো রুমানা।
কিন্তু হঠাৎ দৃষ্টিটা থমকে গেল সামনের এক টুকরো কাঁচের দেয়ালের ওপর। আর সেই মুহূর্তে রুমানার পৃথিবীতে যেন একটা প্রলয় ঘটে গেল।
কেঁপে গেল কণ্ঠের সুর। ওর ছন্দায়িত কণ্ঠের নিভৃতে যেন হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হলো আকস্মিকভাবে।
স্তব্ধ হয়ে হাত থামিয়ে দিলেন তবলচী।
নির্বাক বিস্ময়ে কিছু একটা বুঝতে চাইলেন পরীক্ষকবৃন্দ। অস্থির হয়ে পড়লেন হায়দার মামা। মাথা নত করে থেমে গেল রুমানা। একটু বিরতি। তারপরে জনৈক পরীক্ষকের কণ্ঠ শোনা গেল, ধন্যবাদ।
আশ্চর্য! আর চোখ তুলতে সাহস হলো না রুমানার।
রঙ্গিন কার্পেটের খসখসে রুমে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। পৃথিবীটা তখনো দুলছে। কোনো রকমে দরজাটা খুলে করিডোরে এসে দাঁড়ালো রুমানা। এয়ারকন্ডিশন ছাদের নিচে দাঁড়িয়েও দেয়ালে পিঠ দিয়ে ঘামাতে লাগলো অস্বাভাবিকভাবে।
কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এলো হায়দার। রুমানার রক্তশূন্য মুখের দিকে চেয়ে ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে মা? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
: না। মাথা নাড়লো রুমানা।
তারপরই ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। এসে সোজা ঢুকলো ওয়েটিং রুমে এবং তারপরেই একটা সোফায় ঝুপ করে বসে পড়ে বুকের স্পন্দন শুনতে চাইলো।
বেতার ভবনের লেডিস ওয়েটিং রুমে বসে রুমানা যখন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে খাবি খাচ্ছিল, সেই সময় স্টুডিওর কন্ট্রোল রুমে বসে বিস্মিত বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আরেকটি মানুষ। তাঁর নাম ওস্তাদ সাইফ খান।
পাথরের খোদাই করা এক নিষ্ঠুর মূর্তি যেন। সঙ্গীত পরীক্ষকদের অন্যতম ব্যক্তি তিনি। বিস্মিত হয়েছিল আরো অনেকেই। সঙ্গীত সম্মেলনের শ্রেষ্ঠ শিল্পীর একি ভীরুতা? আশ্চর্য! একের পর এক ‘অডিশন’ দিতে লাগলো সবাই। কিন্তু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সাইফ খান। তাঁর কালো পাথুরে দেহের তন্ত্রীতে জাগলো বিভ্রান্ত ঝড়। মাত্র কিছুক্ষণ আগে যে মানুষটি হার মেনে বেরিয়ে গেল স্টুডিওর দরজা খুলে, তার তো এমনটি হবার কথা নয়!
সাইফ খান তার সাধনালব্ধ ঐশ্বর্যের সবটুকুই তো উজাড় করে দান করেছিলেন রুমানা নামের মেয়েটিকে।
আর সেই সুরের হলাহল আকষ্ঠ পান করে নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল এক কুমারী হৃদয়। কতোদিন কতো অসতর্ক মুহূর্তে তরঙ্গায়িত সুরের সাথে সাথে উত্তাল ঢেউ জেগেছে সাইফ খানের সমাহিত বুকে। চোখে জ্বলেছে দীপকের আগুন। আবার সে আগুন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে গিয়েছে মালহারের আলাপে। বাহারের রাগে কতো বা হৃদয়ের অব্যক্ত ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন তিনি। অক্লান্ত কেঁদেছেন বেহাগের সুরে।
কিন্তু সেই কান্নায়, অশ্রু, সেই অনুভূতি দহনের জ্বালা, কোনদিনও বুঝতে পারেনি রুমানা। বিভোর নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল রাগ জগতের নিলাভ মায়ায়।
ওর জানবার কথা নয়, বুঝবার কথা নয়। অথচ তবুও জানলো।
সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ সাইফ খানের পাথুরের চেহারার দিকে চোখ তুলে তাকাবার অবকাশ কোনদিনই পায়নি রুমানা।
কিন্তু সেদিন কি যেন হলো। নতুন রাগের আলাপে সাইফ খানের কণ্ঠের সাথে একাকার হয়ে গেল রুমানার কণ্ঠ। আর সেই দ্বৈত কণ্ঠের সুরেলা সুরভিতে নেশায় মাতাল হয়ে উঠেছিল চারদিক। রুমানা-গাইছিল: মধু রজনী পোহায়ে যায় সজনী বিনে...।
এমনি করে কতোক্ষণ কেটেছে রুমানা জানে না। গান শেষ করে যখন চোখ খুলল তখনো লোবান পোড়ানো ছাই থেকে মৃদু সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। আর সেই মৃদু। সুরভিটাই যেন হঠাৎ করে আটকে গেল রুমানার বুকের কাছটিতে। সামনে এক জোড়া অদ্ভুত চোখ যেন নিঃশেষ করে দেবে রুমানা নামের মেয়েটিকে।
আশ্চর্য! কেন? কেন এমন বিভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন ওস্তাদজী? কেন এখনো ওই চোখ জোড়ায় সামনে থেকে ছুটে পালাতে পারছে না রুমানা?
কি অর্থ হয় এর? কেন এই অহেতুক প্রলয় তার সুরে বাঁধা এতো দিনকার জীবনে?
রুমানার মনে হলো।
না, মনে হলো নয়; স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে, এ দৃষ্টি বড় সর্বনাশা দৃষ্টি। একটা অনাঘ্রাতা কুমারী হৃদয়কে বিভ্রান্ত কের দেবার জন্যে ওই চোখ। আর তার আগুন অনস্বীকার্য।
কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত ওই জ্বালাময় আগুনের সামনে থেকে ছুটে পালাতে পারলো না রুমানা। ভস্মস্তূপের মতো স্থবির হয়ে বসে রইলো শুধু।
অন্ধকার নেমে এলো চারদিকে। জানালার পাশে কুঞ্জ থেকে হাসনাহেনার সুভাস ভেসে এলো। তবুও যেন সম্বিৎ ফিরে পেল না রুমানা।
সাইফ খানের জ্বালাময় বিভ্রান্ত হৃদয়টা যেন সংযত করতে চাইলো নিজেকে। তিনি উঠে সোজা বেরিয়ে এলেন। একবার তার ইচ্ছে হলো রুমানাকে তিনি জিজ্ঞেস করেন এর কারণ। কেন রুমানা ভয় পেল? কেন সে ভয় পেয়ে এমন ভস্মস্তূপের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল?
পঁয়তাল্লিশের সাইফ খানের ওই চোখ আর তার তৃষ্ণা কি এতোই অবাঞ্ছিত। তাঁর শিল্পী জীবনের সমস্ত সম্পদ সঙ্গীত হৃদয়ের যতো অলঙ্কার, যতো ঐশ্বর্য সবই তো অকাতরে উজাড় করে দিয়েছেন রুমানাকে পরিপূর্ণ করে তুলবার জন্য! সেই সঙ্গে তার স্নেহ-প্রেম বঞ্চিত হৃদয়টাকেও যদি অগোচরে দিয়ে থাকেন তা কি এতোই অপরাধের?
না। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পারেনি সাইফ খান। রুমানার ভয় পাওয়া মূর্তিটি যেন তাঁকে লজ্জা পাইয়ে দিল।
এরপর রুমানার যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন অনেকখানি সময় কেটে গেছে। রুমানা ভাবলো, ও কি তবে এতোক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিল? নাকি এক বিভৎস দুর্ঘটনা ঘটে গেল ওর এতো দিনকার রুটিন বাঁধা নিয়মে?
ওস্তাদজী! হ্যাঁ, ওস্তাদজী কি তবে ওকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন! নাকি বলেছিলেন! কে জানে! ঠিক মনে করতে পারে না রুমানা।
হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে এক সূক্ষ্ম অনুভূতির ঝড় যেন অস্থির করে তুললো রুমানাকে।
একি হয়ে গেল! কেন হঠাৎ ওস্তাদজী এরকম একটা কান্ড করে বসলেন। কী দরকার ছিল এর!
রুমানার মনে হলো ওর সঙ্গীত সাধনা, ওর গুরুভক্তি মিথ্যে। বৃথাই ওর এতো দিনকার দীক্ষা-শিক্ষা। নইলে ওস্তাদের একটা মাত্র আকাক্সক্ষার দাবিকে খুশি হয়ে স্বীকার করতে পারলো না কেন সে?
কি এমন ক্ষতি হতো, যদি ওই আগুনে পোড়ানো দুটি জ্বালাময় চোখকে জানিয়ে দিতে পারতো তার আকাক্সক্ষার উত্তর? যদি বলতে পারতো, হে আমার শিক্ষাগুরু, তোমার শিক্ষার ঐশ্বর্যকে ‘ঘরানাকে’ আমি যেমন ভালোবেসে গ্রহণ করেছি, নিজেকে ধন্য করেছি তেমনি তোমার হৃদয়টাকেও আমি...।
না না, আর কিছুতেই ভাবতে পারে না রুমানা। স্বার্থপর। ভয়ানক স্বার্থপর সে। শুধু একটা কথা, চোখের একটু ভাষা দিতে পারলো না সে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজের কাছ থেকে যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইলো রুমানা, ভুলে থাকতে চাইলো।
এর সপ্তাখানেক পরে আবার যখন সাইফ খান এসে ওপরের ঘরে খবর পাঠালেন রুমানা কে, তখন ভয়ানক রকমের ভয় পেল রুমানা। না না না কিছুতেই সে দেখা করতে পারবে না, ওস্তাদজীর সাথে। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়, যেতে সে কিছুতেই পারবে না।
শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো। ওস্তাদজী বললেন, আগামাী মাসে প্রাদেশিক সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তোমাকে গাইতে হবে।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো রুমানা। আর যেন সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে প্রচন্ড মাথা ঝাঁকিয়ে কেঁদে ফেললো।
: না না না- আমি পারবা না। পারব না, কিছুতেই পারব না।
: তোমাকে পারতেই হবে।
কোথায় যেন বজ্রপাত হলো।
কান্না ভেজা বিস্মিত চোখ তুলে তাকালো রুমানা ।
: ওস্তাদজী।
কিন্তু সাইফ খান তখন ঘরের দরজা পেরিয়ে গেছেন। তাঁর চরম আদেশটা যেন রুমানার জীবনে একটা মৃত্যু দন্ডের আদেশ। কিন্তু এ কেমন বিচার বিধাতার। কেন-কেন এমন অগ্নি পরীক্ষায় ফেলেছেন তিনি রুমানাকে।
আবার যথারীতি আসতে লাগলেন সাইফ খান। সকাল দুপুর সন্ধ্যে-সব সময় চলতে লাগলো সুর-সাগরের জোয়ার ভাটা।
আসন্ন সঙ্গীত সম্মেলনে রুমানার নামটা যেন চোখ জ্বলসে দেবে সবার। রুমানাও যেন নেশায় পাগল হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত দরজায় এসে দাঁড়ালো সেইদিন। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের হল ভর্তি দর্শকদের আকাক্সক্ষাকে ভরিয়ে তুলবার জন্য পর্দা উঠলো ধীরে ধীরে।
আশ্চর্য! সাইফ খানের হাত ধরে মঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ালো রুমানা, যেন একটা পরম নির্ভরতার হাত। একটা দৃঢ় চেতনার হাত।
কয়েক জনের পরেই রুমানার পালা। সাইফ খান বললেন-
: আমি তো রয়েছি। খোদা ভরসা।
খোদা ভরসা করেই বসলো রুমানা। তানপুরায় রইলেন সাইফ খান। তার দিকে একবার চেয়ে সুর মন্ডলে আঙ্গুল ছোঁয়ালো রুমানা। তারপর শুরু হলো সুরের মায়াজাল বোনা।
এভাবে কতোক্ষণ কেটেছে রুমানা জানে না। নেশাগ্রস্ত উন্মাদের মতো সুরের অলিগলিতে ছুটে বেড়াতে লাগলো শুধু। যখন ওর ধ্যান ভাঙ্গলো তখন প্রচন্ড করতালিতে মুখর হয়ে গেছে চারদিক। পরদিন কাগজে ছবি বেরুলো। জীবনী ছাপা হলো। প্রাদেশিক সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম পুরস্কার লাভ করছে রুমানা।
আরো একটা নাম। হ্যাঁ, রুমানার পাশেই যোগ হয়েছে ওস্তাদ সাইফ খানের নাম। রুমানার শিক্ষাগুরুর নাম।
ওস্তাদ সাইফ খানের সেই অমোঘ বাণী-‘তোমাকে পারতেই হবে’ মর্যাদা রক্ষা করেছেন তিনি। তার সবটুকুন ঐশ্বর্যের হৃদয় নিংড়ানো মাধুর্য রুমানার কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে ভুল করেন নি তিনি। সম্মান রেখেছে রুমানা। সাইফ খানের স্বপ্নকে সফল করেছে তার প্রতিভা। আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছে রুমানা। সাফল্যের এই আনন্দ ভুলিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগের সেই ঘটনাকে। সাইফ খানের সেই জ্বালাময় চোখের ভাষাকে।
রুমানার বাবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন ওস্তাদজীও। সবাই বললেন, দেখতে হবে তো কোন ওস্তাদের ছাত্রী।
সাইফ খান হেসে বলেছেন, সবই অধ্যবসায়-
হেসে হেসে কথা বলছে রুমানাও। সবার পরিচয়ও করিয়ে দিচ্ছে ওস্তাদজীর সাথে। কিন্তু তখনো রুমানা বুঝতে পারেনি যেন-ওর এই হাসিটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হবার নয়।
উৎসব রজনীর সর্বশেষ অতিথিটিও যখন বিদায় নিল সাইফ খান তখনো বাবার সাথে কথা বলছেন।
রুমানা এক সময় এসে বলল, ওস্তাদজী আপনার গাড়ি এসে গেছে।
এরপর লনের কাছে এসেই হোঁচট খেলো রুমানা। সাইফ খান একটু দম নিলেন।
তারপর হঠাৎ বললেন, কাল থেকে আমি আর আসছি না রুমানা।
: কেন? বিস্মিত চোখ তুলতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলো রুমানা।
ওস্তাদজীর দু’চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝলকে উঠবে। যেন ক্ষতবিক্ষত আর ক্লান্ত এক ছবি। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হতে চাইলো রুমানা। বলল, আমি বুঝতে পারছি না ওস্তাদজী।
রুমানাকে বুঝিয়ে বলবার মতো অবস্থা তখন সাইফ খানের ছিল না। শুধু মুখ ঘুরিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, আমার এ দানকে কোনদিনও অবহেলা করো না রুমানা। তাহলে আমি বড় কষ্ট পাব।
দেয়ালে ভর দিয়ে নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করলো রুমানা। একটা প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় যেন ফেলে দিতে চাইছে ওকে। শেষ পর্যন্ত ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল রুমানা।
সাইফ খানের গাড়ি চলে গেছে অনেক্ষণ আগে। সেটাই ছিল তার শেষ যাওয়া। ওস্তাদ সাইফ খানের সেই জ্বালাময় তৃষ্ণার্ত চোখ! সঙ্গীত সম্মেলন! আর চলে যাওয়ার সেইদিন। সব ছবি যেন এলোমেলো হয়ে গেল। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার আগুন রুমানার হৃদয়টাকে যেন পুড়ে ছার খার করে দিল।
সাইফ খান তার সেই আকাক্সক্ষার চোখ এবং দাবি নিয়ে আর কোনদিনও এসে দাঁড়াননি রুমানার সামনে। তার স্বপ্নকে তিনি সফল করেছেন রুমানার কণ্ঠের মাধ্যমে। তারপরেই নিজেকে তিনি আড়াল করে ফেলেছেন।
দুঃখ পেয়েছেন।
লজ্জা পেয়েছেন।
রুমানার মতো একটা কাব্যিক-সুরেলা মেয়ের চোখে চোখ রাখার স্পর্ধাকেই ধিক্কার দিয়েছেন সাইফ খান।
অথচ তার সেই রক্তাক্ত হৃদয়ের শুভাশীষ অবিরত ঝরে পড়েছে রুমানার জীবনে। অভিশাপ। না না, এমন কথা ভাবতেও বড় ভয় হয় সাইফ খানের।
কষ্ট তিনি পেয়েছেন। এই যন্ত্রণার জ্বালা হয়ত তার বাকি জীবনটাকেও ধিকি ধিকি করে পুড়িয়ে মারবে।
কিন্তু তাই বলে রুমানার অমঙ্গল এটা তিনি কখনো কামনা করেন না।
রুমানা!
রুমানা যে তারই সৃষ্টি। ওর কণ্ঠের ঝংকৃত সুর, গমক-তাল-লয়, আলাপের ওই বিহ্বল ভঙ্গি সব তো সাইফ খানের হাতের গড়া সম্পদ।
সঙ্গীত সম্মেলনের রুমানার সাফল্যের জন্য রাত জেগে অক্লান্ত ফরিয়াদ করেছেন তিনি বিধাতার কাছে আর রুমানাকে জানিয়ে দিয়েছেন-
: তোমাকে পারতেই হবে।
কিন্তু আজ!
কেন এরকম একটা অসম্ভব কান্ড করতে গেল রুমানার মতো মেয়ে।
দু’ঘণ্টা আড়াই ঘন্টা নয়-মাত্র তিন মিনিটের একটা অডিশন যা রুমানার কাছে ছেলেখেলা-তাতেই...?
ছিঃ ছিঃ ছিঃ তবে কি সাইফ খানের সেই অভিশপ্ত চোখের দিকে তাকিয়েই এ বিভ্রান্তি ঘটেছে রুমানার?
সাইফ খানের ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে সবাইকে আবার বলেন দোহাই আপনাদের, আপনারা আবার রুমানার অডিশন নিন। ও ফেল করবার মেয়ে নয়। সঙ্গীত সম্মেলনের সেই বিজয়িনী এই মেয়ে-ই।
কিন্তু পারলেন না।
অসহ্য। তাঁর সৃষ্টি-সাধারণ একটা নিয়মের কাছে হার মেনে যাবে... এ যে ওস্তাদ সাইফ খানের কতো বড় লজ্জা, কতো যন্ত্রণার উৎস তা আর কেউ না বুঝুক, রুমানা অন্তত বুঝবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এলেন সাইফ খান। ইচ্ছে হলো এক্ষুনি গিয়ে রুমানাকে তিনি বলবেন- ‘তোমাকে পারতেই হবে।’
তিনি না হয় বেতার কেন্দ্রে একটা পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও আড়াল হয়ে যাবেন। কিন্তু তবুও যেন কোনো বিভ্রান্তি না আসে রুমানার সঙ্গীত সাধনে।
পৃথিবীর মানুষ নাই বা জানলো ওস্তাদ সাইফ খানের পদত্যাগের ইতিহাস। রক্তক্ষরণের বেদনাক্ত কাহিনী। আর শিল্পী সৃষ্টির জবানবন্দী। তবুও যেন রুমানার সুরেলা কণ্ঠের রেশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীকে ভরিয়ে দেয়।
লেডিজ ওয়েটিং রুমের সামনে এসে চারদিকে তাকালেন সাইফ খান। বুঝলেন রুমানা চলে গেছে। চলে গেছে তার এতোদিনকার স্বপ্নকে, সাধনাকে চরম অপমানের মুখে ঠেলে দিয়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।