Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সত্যিই, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়

ফুটবলকে ঋণী করে পেলের চিরবিদায়

স্পোর্টস রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়/প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’- আসলেই কি তাই? হয়তো বা। যেমন নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে এবার আকাশের বুকে বাসা বেধেছেন ফুটবলের প্রথম জাদুকর। টমাস এডিসনের নামানুসারে তার বাবা নাম রেখেছিলেন নাম এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো। ডাকনাম ছিল ডিকো। তবে সারা পৃথিবীময় তিনি পরিচিত ছিলেন পেলে নামে। নামটাই যথেষ্ট ছিল তার মাহাত্ম্য বুঝানোর জন্য। বলা হয় ফুটবলটা চির ঋণী দুইজন ব্যক্তির কাছে। ম্যারাডোনাতো ২০২০ সালের নভেম্বরে কোভিড মহামারির মাঝেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন। তার অকালপ্রয়াণটা বিশ্বাস করে উঠার আগেই বিদায় নিলেন চর্মাকার গোলবস্তুর আরেক জাদুকর পেলে। পরশু মধ্যরাতে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন তিনি জীবঘাতী ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে। যাওয়ার আগে রেখে গিয়েছেন এক বিশাল ফুটবল উত্তরসূরী। যারা শয়নে, স্বপনে, জীবনে ফুটবলটাকেই প্রার্থনা করে নিয়েছেন ঠিক পেলের মত করেই।
পেলের নামের পাশে আছে তিনটি বিশ্বকাপ। এই পৃথিবীতে এই কৃতী যে কেবল কালো মানিকেরই। তাছাড়া অর্জনের খাতায় আরও আছে অগণিত ট্রফি, সম্মান এবং নানা বর্ণের ও রঙের স্মৃতি। সারাজীবনে এই ফরোয়ার্ডকে থামাতে পারেনি কোন নামী-দামী ডিফেন্ডার বা গোলরক্ষক। সেই বীরকে অবশ্য বহুদিন ধরেই কাবু করার চেষ্টায় ছিল বিভিন্ন রোগ বালাই। শেষ কইয়েক বছরতো হাসপাতালকেই দ্বিতীয় বাড়ি বানিয়েছিলেন। লড়াই থামাননি এই যুদ্ধেও। তবে জীবনের শেষ লড়াইটাতে হার মানতে বাধ্য হলেন কালো মানিক।
ব্রাজিলের ছেলেরা তো জন্মের পরেই প্রথম উপহার পায় একটি ফুটবল। মিনাস জেরাইসে জন্ম নেওয়া পেলও সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের ফুটবলার ডোনডিনহো। তবে তখনকার ফুটবলারড়া কিন্তু হালের এমবাপে-মেসি-রোনালদোদের মত বেত্ন পেতেন না। তাই পেলের ছেলেবেলা কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। তখনকার দিনে ফুটবলাররা সে রকম বেতন পেতেন না। ফলে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট রোজগার করা তার বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাবার দেখাদেখি ফুটবলের প্রতি ছোট থেকেই ঝোঁক। পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। চায়ের দোকানে কাজ করে হাতখরচ জোগাড় করতেন। বাকি যে সময় পেতেন, রাস্তাতেই ফুটবল খেলা চলত। সেই পেলেই পেশাদার ক্যারিয়ারে ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সান্তোসে নাম লেখায় একদিন। পেলেকে সান্তোসে নিয়ে যায় ওয়ালদেমার দে ব্রিটো। সান্তোসের কর্তাদের কাছে গিয়ে আত্মবিশ্বাসী ব্রিটো বলেন, ‘এই ছেলে একদিন বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে’! শুধু কথায় কি আর চিড়ে ভিজে? মোটেই না, সান্তোসের তখনকার কোচ লুলার সামনে ট্রায়াল দিতে হলো। মুগ্ধ লুলা ১৯৫৬ সালের জুনে প্রথম পেশাদার চুক্তি সই করান পেলের সঙ্গে। পরের মৌসুমেই প্রথম দলে খেলার সুযোগ পান পেলে এবং লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। তত দিনে ব্রাজিলে হইচই পড়ে গিয়েছে তাঁকে নিয়ে। পেশাদার ক্লাবে সই করার ১০ মাসের মধ্যে জাতীয় দলে সুযোগ পান।
তবে সান্তোস পর্যন্ত আসাটা পেলের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। তার ফুটবলের হাতেখড়ি কিন্তু চামড়ার ফুটবল দিয়ে নয়। মোজার ভিতরে কাগজ ঢুকিয়ে সেটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রথম লাথালাথি শুরু। বয়স কিছুটা বাড়ার পর আসল ফুটবলে লাথি মারার সুযোগ পেয়েছিলেন পেলে। স্থানীয় বাউরু এলাকার বিভিন্ন অপেশাদার লিগে খেলার সুযোগ মিলেছিল ছোটবেলায়। তবে সেটা ছিল অনেকটা গ্রাম বাংলার খেপ খেলার মত। সেই সময়েই পেলে জানান দিয়েছিলেন তার গোল করা এবং বল ড্রিবলিং করার ক্ষমতা জন্মগত। ঠিক সেই সময়টাতে ব্রাজিলে দারুণ জনপ্রিয় হচ্ছিল ‘ফুটসল’। অর্থাৎ ইনডোর ফুটবল আরকি। ছোট্ট পেলে চুটিয়ে সেই খেলাই খেলেছেন। তিনি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হওয়ার পর বলেছিলেন- ছোট জায়গায় বল ড্রিবল করার ক্ষমতা এবং দুরূহ সব কোণ থেকে গোল করার ক্ষমতাটা তিনি অর্জন করেছিলেন ফুটসল খেলেই।
পেলের শুরুটা ভালো হয়নি ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে। সুইডেনে তিনি খেলতে গিয়েছিলেন হাঁটুর চোট নিয়ে। প্রথম ম্যাচে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে সেই ম্যাচে একটি গোল বানিয়ে দেন কালো মানিক। তবে একটা রেকর্ড গড়ে ফেলেন। তা হচ্ছে সব থেকে কম বয়সে বিশ্বকাপে খেলার মাইলফলক। সেমিফাইনালে ফ্রান্সকে পেয়ে করলেন হ্যাটট্রিক। মজার ব্যাপার কি জানেন? সেটাও সব থেকে কম বয়সে। ফাইনালে স্বাগতিকদের বিপক্ষে জোড়া গোল পেলেকে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ফুটবলারের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। পরের বিশ্বকাপে তিনি গিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে। ততদিনে দলে গ্যারিঞ্চা, গিলমারের মতো তারকা ফুটবলারও চলে এসেছেন। তবে চেকোসেøাভাকিয়ার বিপক্ষে দূরপাল্লার শট মারতে গিয়ে চোট পড়ে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যান। তবে গ্যারিঞ্চার সৌজন্যে সেই বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ব্রাজিল। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৬৬ বিশ্বকাপ সব থেকে খারাপ যায় ব্রাজিলের কাছে। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় সেলেসাওরা। তারপর মেক্সিকোতে ১৯৭০ সালের বিশ্বআসর ছিল পেলের জীবনে শেষ এবং অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয় ম্যাচে, কার্লোস আলবার্তোকে দেওয়া পেলের সেই পাস এখনও ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে রয়েছে।
ক্লাব পর্যায়ে পেলেকে পাওয়ার জন্য ইউরোপিয়ান জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ইন্টার মিলানসহ একাধিক ক্লাব টাকার থলি নিয়ে বসেছিল। কিন্তু ব্রাজিল ছেড়ে অন্য কোথাও খেলতে যাননি তিনি। অর্থকে বরাবরই দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ১৮ বছর সান্তোসে খেলেছিলেন। ৪৯৩ ম্যাচে করেছিলেন ৫০১টি গোল। এরপর নাম লেখান আমেরিকার নিউ ইয়র্ক কসমসে।
প্রতিটি মানুষই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হওয়া দায়িত্ব। পেলেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন রাজনীতির মাঠে। তবে কোনও দিন প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি। বুটজোড়া তুলে রাখার পর বিভিন্ন দেশে গিয়ে ফুটবলের প্রসারে বহু কাজ করেছেন পেলে। ইউনেস্কোর ‘গুডউইল অ্যাম্বাসাডর’ হয়ে কাজ করেন তিনি। বয়স বাড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক সমস্যায় পড়েন। হুইলচেয়ারে করে ২০১৭ সালে বিশ্বকাপের ড্রয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপরেই বাড়িতে পড়ে গিয়ে গুরুতর চোট পান। রাশিয়া বিশ্বকাপে শারীরিক অসুস্থতার কারণেই হাজির থাকতে পারেননি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিয়মিত তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হত। কাতার বিশ্বকাপে অনুজদের খেলা দেখেছেন হাসপাতাল থেকে। অবশেষে হার স্বীকার করতে হলো মৃত্যুর কাছে।
তবে পেলের মত কিংব্দন্তীর কি মৃত্যু হয়? তিনি বেঁচে থাকবেন ব্রাজিলের প্রতিটি অলি-গলিতে ফুটবল পায়ে ঝড় তোলা কচি-কাচার দলে। সারা পৃথিবীময় কোটি-কোটি ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে। তাই নশ্বর পৃথিবী ছাড়ার পরো অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন কালো হীরেটি। ঠিক যতদিন ফুটবল বাঁচবে এই ধরনীর বুকে ততদিনই তার নাম চীর অম্লান হয়ে থাকবে। কেবল রক্ত-মাংসের শরীরটা বিদায় নিচ্ছে ধরণীর বুক থেকে।

 

এক নজরে পেলে
নাম : এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো
জন্ম : ২৩ অক্টোবর, ১৯৪০
মৃত্যু : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২
ডাক নাম : ডিকো
ফুটবল বিশ্বে : পেলে
ব্রাজিল মূল দল (১৯৫৭-১৯৭১)
পজিশন : এটাকিং মিডফিল্ড
ম্যাচ ৯২ গোল ৭৭
বিশ্বকাপ জয় ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০
বিশ্বকাপে গোল ১২টি
ক্লাবের হয়ে
সান্তোস (১৯৫৬-১৯৭৪)
ম্যাচ ৪৯৩ গোল ৫০১
কসমস (১৯৭৫-৭৭)
ম্যাচ ৬৪ গোল ৩৭

অর্জন
১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলয়াড়
১৯৭০ বিশ্বকাপের সেরা
১৯৭৭ বিশ্ব নাগরিকের মর্যাদা লাভ
১৯৮৪ ফিফা অর্ডার অফ মেরিট
১৯৯৩ ইউনোস্কো নির্বাচিত শুভেচ্ছা দূত
২০০০ ম্যারাডোনার সঙ্গে যৌথভাবে ফিফার শতাব্দী সেরা
২০০৪ ফিফা সেন্টিনিয়াল পুরষ্কার

 

রেকর্ড
ব্রাজিলের হয়ে সর্বাধিক ৭৭ গোল
বিশ্বফুটবলের সর্বাধিক হ্যাটট্রিক ৯২
একমাত্র ফুটবলার হিসেবে সর্বাধিক বিশ্বকাপ জয় ৩টি
সবথেকে কম বয়সে বিশ্বকাপ জয়ী ১৭ বছর ২৪৯ দিন
সবথেকে কম বয়সে বিশ্বকাপ গোল ১৭ বছর ২৩৯ দিন
সবথেকে কম বয়সে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক ১৭ বছর ২৪৪ দিন
সবথেকে কম বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল ১৭ বছর ২৪৯ দিন
এক বছরে সর্বাধিক ১২৭ গোল (১৯৫৯)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ