পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
উল্টোপথে সঞ্চয়পত্রে -ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন
জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে -ড. জায়েদ বখত
বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় ভোক্তাদের নাভিশ্বাস। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট ধরতে অভিযান চালানোসহ কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তাই দিনকে দিন ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তেল, চাল, আটা, চিনি, ডাল, পেঁয়াজসহ সব খাদ্যপণ্যের দাম। পাশাপাশি প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে সাবান, টুথপেষ্ট, গুঁড়াদুধসহ অন্যান্য নিত্য পণ্যের দামও। ফলে নিত্যপণ্য কিনে সংসার চালাতে গিয়ে মানুষের হাত পড়েছে সঞ্চয়ের ওপর। সংসার চালাতে মানুষ তার সঞ্চয়ের টাকা ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে। ব্যাংক আমানতের সুদহার কম। আবার সময়মতো গ্রাহকের অর্থফেরত না দেয়া, অনিয়মের কারণে দেউলিয়া হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষ আস্থা তলানিতে। শেয়ার বাজার বা বন্ড মার্কেট দীর্ঘদিন পর আস্থা ফিরলেও অতীত অভিজ্ঞতাও বেশ নেতিবাচক। দেশে প্রবীণ, কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যাপক অর্থে কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। তাই সরকার অল্প আয়ের মানুষদের জন্য নিরাপদ সঞ্চয়ের সুযোগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি সুদে বিনিয়োগের সুযোগ রেখেছিল। যাতে প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষ উপকৃত হন। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় এবং দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ সেখানেও পড়েছে। আর তাই সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রিও তলানিতে ঠেকেছে। এমনকি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ উল্টোপথে হাটছে। বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে বেশি টাকা চলে যাচ্ছে। আর সে কারণে উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছে না সরকার। উল্টো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর এতে বেড়ে যাচ্ছে সরকারের ব্যাংকঋণের পরিমাণ। অথচ বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর বিপরীতে প্রথম পাঁচ মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির গত বুধবারের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) হয়েছে। অর্থাৎ এই পাঁচ মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো এই পরিমাণ টাকা সরকার তার কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সবশেষ নভেম্বর মাসে মোট ৬ হাজার ৮৮৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। মুনাফা ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ফলে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৯৭৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্র খাতে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে সরকার। অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ছিল। আগের মাস সেপ্টেম্বরেও নিট বিক্রি ৭০ কোটি ৬৩ হাজার টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ছিল। তার আগের মাস আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
এক সময়ে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি। কারণ সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বলতে দেশে কিছুই নেই।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। সরকারকে কোষাগার থেকে সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেই খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। আহসান মনসুর বলেন, উন্নয়ন কর্মকান্ড বাজেটের অন্যান্য খরচ মেটাতে বছরের পর বছর ধরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে আসছিল সরকার; কিন্তু এখন ঋণ বা ধার করা তো দূরে থাক, যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে, তা দিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসলই মেটানো যাচ্ছে না। বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধেই চলে যাচ্ছে বেশি। অর্থাৎ সরকারের কোষাগার থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধ করতে হচ্ছে।
সূত্র মতে, সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকেই বিক্রি কমছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, এমনিতেই আড়াই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই বেশি ছিল। যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে গেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ এবং আগস্টে ছিল আরও বেশি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বশেষ নভেম্বরে মজুরি স‚চক ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। বিবিএসের এই তথ্যই বলছে, দেশের মানুষ যা আয় করছে, তা দিয়ে তার সংসারই চলছে না; সঞ্চয় করবে কীভাবে?’ উল্লেখ করেন ড. জায়েদ বখত।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে গ্রাহকদের মূল টাকা (বিনিয়োগ) ও মুনাফা (সুদ) বাবদ পরিশোধ করা হয় ৮৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকারকে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫২ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল। সে হিসাবে দেখা যায়, গত অর্থবছরে লক্ষ্যের চেয়ে এই খাত থেকে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কম ঋণ নিয়েছিল সরকার।
২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৭০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়। সে হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে, ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মস‚চি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ না পাওয়ায় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ এই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর) ৩১ হাজার ৩৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। গত বছরের একই সময়ের এই ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় অর্ধেক, ১৭ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।