হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
সাধারণত ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সবকিছু যখন স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি অনুযায়ী ও আইনানুগভাবে চলতে থাকে, তখন এ শব্দটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। যখনই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বা চলতে থাকে, তখনই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আসে এবং কর্তৃত্বের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। আমরা যদি রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতির বিষয়টি বিবেচনা করি, তাহলে সেখানে যদি বলা হয়, ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে’ তখন এর মধ্যে একধরনের জোরজবরদস্তির আভাস পাওয়া যায়। এ কথা সবার জানা, রাষ্ট্র আবর্তিত হয়, রাজনীতির ওপর ভর করে। এক্ষেত্রে ‘সু’ বা ‘কু’ দুই ধরনের রাজনীতিই হতে পারে। এটা নির্ভর করে রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃবৃন্দের মানসিকতার ওপর। রাজনীতি যদি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে চলে, তাহলে রাষ্ট্রও সে পথে এগিয়ে যায়। অন্যথায় রাষ্ট্র স্বৈর ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পড়ে। যে শাসক বা তার দল এ নীতি অবলম্বন করে, তখন তাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’র উপর নির্ভর করতে হয়। তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিরোধী রাজনীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ নিতে হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি অপবাদ দিয়ে ও কলঙ্কলেপন করে আচ্ছা-রকমে শায়েস্তা করা ও দমননীতি অবলম্বন করা তার জন্য অনিবার্য হয়ে উঠে। এছাড়া তার ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। উপমহাদেশে ব্রিটিশরা যখন শাসন করতে শুরু করে, তখন থেকেই এ ধারা চলে আসছে। সে সময় যারাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে, তাদের করুণ পরিণতির কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তাদের অমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়ন-নির্যাতন, জেল, জুলুম এবং মৃত্যুদ-ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এভাবে প্রতিপক্ষ বা বিরোধী মতকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিটিশরা দুইশ’ বছর নির্বিঘেœ শাসনের মাধ্যমে তাদের সবটুকু স্বার্থ হাসিল করে বিদায় নিয়েছিল। জবরদস্তিমূলক ও স্বৈরশাসন এমনই হয়। এ শাসন ব্যবস্থায় জনগণের প্রাপ্তি খুবই সামান্য হয়, শাসকরাই শোষণ করে সব নিয়ে যায়। ব্রিটিশরা যেভাবে তার বিরোধীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন ব্যবস্থার সংস্কৃতি চালু করে গিয়েছিল, পরবর্তীতে সে ধারা উপমহাদেশের ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও অব্যাহত ছিল। ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে আরও কঠোরভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন করা শুরু করে। আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের কথা আমরা সকলেই জানি। বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, দমন এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মুক্তিকামী মানুষকে অনেক প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাদেরই বিজয় হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় আন্দোলন, সংগ্রাম এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। মুক্তিকামী মানুষের লক্ষ্য ছিল একটাই, নিয়ন্ত্রণমূলক ও স্বৈর বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি, ন্যায়ভিত্তিক শাসনের মাধ্যমে জীবন যাপন করা। এই লক্ষ্য কতটা পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে এখন ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, স্বাধীন দেশে যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তীব্রতার কিছুটা হেরফের হলেও, তারা ব্রিটিশদের সেই নিয়ন্ত্রণমূলক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার ধারাকেই অনুসরণ করেছে এবং করে চলেছে। ঔপনিবেশিক এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলার জনগণকে বারবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে এবং জীবনও দিতে হয়েছে। বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদই ছিলেন সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরশাসক। দীর্ঘ ৯ বছর তার এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। রাউফুন বসুনিয়া, নূর হোসেন, জেহাদ, ডা. মিলনের মতো অনেক ছাত্র ও পেশাজীবীর জীবন দিতে হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার জন্য এবং টিকিয়ে রাখার জন্য সুবিধাবাদী একটি শ্রেণী সবসময়ই ছিল, এখনও আছে। ইংরেজদের যেমন ছিল তেমনি, আইয়ুব, ইয়াহিয়া খান, এরশাদের টিকে থাকার পেছনেও তাদের বাহিনী ও কিছু সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দল ছিল। এদের কারণে মসনদ দখলকারী স্বৈরশাসকের কর্তৃত্ববাদী ও নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এই নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ আজও বের হতে পারেনি। ঔপনিবেশিকতা শেষ হলেও ঔপনিবেশিক শক্তির মানসিকতা টিকে আছে অন্য রূপে এবং মাধ্যমে। যাকে বলে নব্য উপনিবেশবাদ।
দুই.
বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে। দেশে-বিদেশে এ শাসন ব্যবস্থা ইতোমধ্যে কর্তৃত্ববাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে এই কর্তৃত্ববাদ সরাসরি স্বৈরশাসকের মতো না হলেও এর মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক বাতাবরণ রয়েছে। কারণ, যে দলটি ক্ষমতায় তাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এই দলের বিরুদ্ধেই কর্তৃত্ববাদের অভিযোগ উঠেছে এবং বেশ জোরেশোরেই তা উচ্চারিত হচ্ছে। এতে অবশ্য দলটি তেমন গা করছে না। তার নেতা-কর্মীদের শারিরীক ভাষায়ও এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ লক্ষ্যণীয়। এর কারণ হচ্ছে, এ সরকারের বিরুদ্ধে দুই-দুইবার আন্দোলন করে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে এবং গত বছর এই নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন থেকে একটানা প্রায় তিন মাস আন্দোলন করে দলটি সফল হতে পারেনি। এই সফল হতে না পারায় ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এতটাই আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, সে মনে করছে, তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর মতো কোনো শক্তি বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর বুকেও নেই। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। অতি আত্মবিশ্বাস রূপ নিয়েছে কর্তৃত্ববাদে। তার আগে সরকার যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে, ব্রিটিশদের মতোই পুরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী দলের আন্দোলন দমাতে নামিয়ে দিয়েছিল। তাদের এতটাই ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল যে, দেখা মাত্র গুলির মতো জীবন বিনাশী নীতি অবলীলায় প্রয়োগ করতে পারত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেছিলও। স্বৈরশাসক নয়, ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দল তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এমন দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তা গণতন্ত্রকামী মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। এই দমনমূলক ব্যবস্থাকে জায়েজ করতে স্বৈরশাসকরা চিরায়ত যে কারণ দাঁড় করায়, এই সরকারও তাই করে চলেছে। বিরোধী দল ধ্বংসাত্মক কাজ করছে, মানুষের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, কাজেই জনগণের নিরাপত্তা বিধানে যা করা প্রয়োজন তাই করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রধান বিরোধী দলকে স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি দল হিসেবে আখ্যা দিয়ে দমননীতি অব্যাহত রেখেছে। স্বৈরশাসকরা যেভাবে খারাপ নাম দিয়ে (‘গিভ এ ডগ ব্যাড নেইম অ্যান্ড বিট ইট’ নীতি) প্রতিপক্ষকে দমন করেছিল, সেই পন্থাই অনুসরণ করা হচ্ছে। সরকারের এই নীতি সাফল্য লাভ করে এবং এই সাফল্য লাভের কারণ তার রাজনৈতিক ভিত্তি এবং পরিচয় রয়েছে। দলটির ভারতমুখাপেক্ষিতাও অন্যতম শক্তি হিসেবে করছে। তার পেছনে ভারতের একতরফা সমর্থন ও কূটবুদ্ধি এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারত পরমবন্ধু ছিল এমন দোহাই দিয়ে তার তোষণ নীতিও ক্ষমতায় থাকার অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে। দেশের জনগণ কি মনে করলো, না করলোÑ এ বিষয়টি অনেকটা থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। এর বিপরীতে কৌশল হিসেবে উন্নয়নের ক্যানভাস জনগণের সামনে তুলে ধরে তাতে রঙিন স্বপ্নচিত্র এঁকে চলেছে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর জনগণ তাকে চাচ্ছে কি, চাচ্ছে না, তা সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের আচরণ কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরশাসনের লক্ষণ। কোণঠাসা বিরোধী দল তো অহরহ বলে চলেছে, এ সরকার হিটলারকেও হার মানিয়েছে। তবে অস্বীকারের উপায় নেই, সরকার গণতন্ত্রের যে স্বাভাবিক ধারা ও বিস্তার, তা বেশ কঠোরভাবেই নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। যেখানে নেহায়েতই গণতন্ত্র না হলে চলে না, সেখানে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ার মতো একটু একটু করে ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। তারা গণতন্ত্রকে চিড়িয়াখানার বাঘের মতোই গ্রিল দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দি করে রেখেছে। দর্শকও সেই বাঘ দেখছে। তবে দর্শকের এভাবে বাঘ দেখা বাঘের কোনোভাবেই ভালোলাগার কথা নয়। কারণ সে চায় মুক্ত চারণভূমি। গ্রিল দেয়া কোনো জায়গা নয়। সুশীল সমাজের অনেকেই ঠারেঠুরে বলেন, গণতন্ত্র এখন বাক্সবন্দি। গণতন্ত্র বিকাশের সবচেয়ে বড় যে মাধ্যম সেই গণমাধ্যমও সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তবে টেলিভিশন টকশোতে সরকারপন্থী আলোচকরা গণতন্ত্র যে আছে তা জায়েজ করার জন্য বলে চলেছেন, ‘এই যে আমরা কথা বলতে পারছি, এটা কি গণতন্ত্র নয়? সরকার কি বাধা দিয়েছে?’ তাদের এ যুক্তি শুনে গণতন্ত্রকামী মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি সরকার চুইয়ে পড়া গণতন্ত্রের এটুকুও দিতে চায় না? এ ধরনের সরকারদলীয় চাটুকারজীবীদের কথা শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক, তাদের কাছে গণতন্ত্র বলতে সরকারের পক্ষে তাদের অবাধ গুণগানকেই বোঝেন।
তিন.
অনেকে বলেন, সরকার গণতন্ত্রকে চাপা দিয়ে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিষয়টি অনেকটা এরকম, ভাত দেব, কথা বলতে পারবে না। সরকারের তরফ থেকে এ মত নিয়ে দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্রকে চাপা দিয়ে সরকারের এ উন্নয়ন নীতি কতটা সফল হচ্ছে? এ নিয়ে বিশ্লেষকদের নানা মত রয়েছে। তবে বেশিরভাগেরই মত, উন্নয়ন গতিশীল করতে গণতন্ত্রকে সাথে নিয়েই করতে হবে। গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন টেকসই হয় না, তাতে জবাবদিতাও থাকে না। খুব বেশি দূরও এগোনো যায় না। যদি তাই হতো, তবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ন্ত্রিত বা গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন কার্যক্রম এখনো চলত। তারা গণতন্ত্রকে মুক্ত করে দিত না। এমনকি যে ভারতের তত্ত্ব ও পরামর্শে সরকার চলছে বলে অনেকে মনে করেন, সে ভারতেও গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিতই থাকত। সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও তার কার্যক্রম দমন করে ঠা-া করতে পারলেই উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত করা যাবে। সরকার করেছেও তাই। এখন বিরোধী দলের কোনো আন্দোলন, সংগ্রাম ও লাঠালাঠি নেই। এ অবস্থায় সরকার কী উন্নয়ন করছে, তা বিচার্য বিষয়। সচেতন মানুষ দেখছে, সরকার পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর লেন জাতীয় কিছু প্রকল্প হাতে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকা-কে বড় করে তুলে ধরছে। এর পাশাপাশি অর্থনীতির মূল সূচক জিডিপির গ্রোথ কাগজে-কলমে ৭ হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করছে। মাথাপিছু আয়ও কাগজে কলমে ২ ডলার বাড়িয়ে ১৩১৬ ডলার দেখাচ্ছে। অথচ বাস্তবের সাথে এর তেমন কোনো মিল নেই। বাস্তবে অর্থনীতিবিদরা দেখছেন, রফতানির প্রধানতম খাত পোশাক শিল্প দিন দিন নাজুক হয়ে পড়ছে। বিদেশি রেমিটেন্স আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। জনশক্তি রফতানির বাজার দীর্ঘদিন ধরে সঙ্কুচিত হয়ে রয়েছে। বিনিয়োগ স্মরণকালের নি¤œতম স্তরে বিরাজ করছে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের যে বার্ষিক উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা এডিপি বাস্তবায়নের হার, তা গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে নি¤œস্তরে রয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব এবং অর্থছাড়ে বিলম্বের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বলাবাহুল্য, সরকারের নেপথ্য নীতি হচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকা-কে ডা-া মেরে ঠা-া করে উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত চালানো। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির মাঠ তো এখন স্থিতিশীল, তাহলে এডিপি বাস্তবায়ন কেন নি¤œস্তরে থাকবে? সরকার কি পারে না, এডিপি বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান করতে? এ ক্ষেত্রে কি সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি ব্যর্থ হচ্ছে না? শুধু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেই কি উন্নয়ন তরতর করে এগিয়ে যাবে? হ্যাঁ, উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই। তবে দমনমূলক ও নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক পরিবেশে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন যে সম্ভব নয়, তা তো অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকই বলে দিচ্ছে। তার উপর বৈদেশিক সহায়তা কমে গেছে। যেসব সহায়তা পাইপ লাইনে রয়েছে, তা ব্যবহার করার সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। এর পেছনে কোণঠাসা করা প্রধান রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও আলোচনা করা জরুরি। কারণ বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে যে দল একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল, তারও উন্নয়ন সংশ্লিষ্টতা এবং কিছু ম্যাকানিজম ছিল। পাশাপাশি বিদেশি সুহৃদও ছিল এবং আছে। যখন তাকে চরম নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও দমিয়ে রাখা হয়, তখন কি ঐসব ম্যাকানিজম ও বিদেশি সুহৃদরা ঠিকভাবে কাজ করবে? স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তা করার কথা নয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলটির এ প্রভাব তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা দেখছি, বর্তমান সংসদের পুতুল বিরোধী দলের সাথে নয়, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রীর সাথেই বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো অহরহ দেখা-সাক্ষাৎ এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করছে। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে বিদেশি রাষ্ট্রের সুসম্পর্কের কথা বাদই দেয়া যাক। এর বাইরে কি অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ সরকারকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফেরার তাকিদ দিচ্ছে না? প্রায় প্রতিনিয়তই তো পত্র-পত্রিকায় খবর বের হয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর জোর দিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে। এমনকি সরকারের ঘনিষ্ট মিত্র যে ভারত, সেই ভারতেরই প্রভাবশালী পত্রিকায় সম্পাদকীয়সহ প্রখ্যাত কলামিস্টরাও সরকারকে গণতান্ত্রিকধারায় ফেরার পরামর্শ দিয়ে কলাম লিখছেন। এই গত সপ্তাহে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সবদলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ম্যাকানিজম বের করার কথা বলেই দিয়েছে। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে, নির্বাচনে জনগণের আস্থা থাকতে হবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলের এ কথা বলার অর্থ বোঝার জন্য তো খুব বেশি মাথা ঘামানোর দরকার হয় না। গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের কথা বলার অর্থই হচ্ছে, বর্তমান সরকার অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় রয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে এবং সরকার কর্তৃত্ববাদী আচরণ করছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব এবং তাদেরকে ক্ষমতাবলে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। তা না হলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলের এ কথা বলার প্রয়োজন পড়ত না।
চার.
নদীর স্বাভাবিক গতিধারায় বাঁধ দিলে তা যে কোনো উপায়ে গতিপথ বদলাবেই। এ বদলানো কোনোভাবেই কল্যাণকর হয় না। এর নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একইভাবে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারা রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হলে, তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও ব্যাপক হয়। বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক শক্তির উদ্ভব ও সঙ্কট সৃষ্টি হয়। সরকারকেও স্বৈরাচারের বদনাম নিতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের অন্যতম চালিকাশক্তি ‘রাজনীতি’র উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পরিবর্তে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত এই উভয় বিভাগেই এখন নানা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীনতার কবলে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য কিভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে, তা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে যখন নিয়ন্ত্রণ বা রোধ করা হয়, তখন এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অনিবার্যভাবেই সবখাতে পড়বে। কূটনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়াসহ ভারসাম্যহীন হয়ে উঠবে। এসব ক্ষেত্র তখনই ভারসাম্য হারায়, যখন সরকারের গণভিত্তি থাকে না। জনগণের রায়ের তোয়াক্কা করা হয় না। যখন ৫ জানুয়ারির জনভিত্তিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার উদ্যোগ নেয়া হলো, তখন সরকারের মধ্যে এক ধরনের জবরদস্তিমূলক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ধমক দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয় এবং এখনও করা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, হুমকি-ধমকি কেউই পছন্দ করে না। এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও, দীর্ঘ পরিসরে তা সম্ভব নয়। কারণ প্রকৃতির নিয়মেই ক্ষমতাবান চিরকাল ক্ষমতাবান থাকে না। ক্ষমতার ক্ষয় হবেই। তখন তার ক্ষমতার অপব্যবহারের যে পরিণতি হয়, তা করুণ। পৃথিবীখ্যাত স্বৈরশাসকদের ইতিহাসের দিকে তাকালেই তা দেখা যায়। তাদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিল, তা সকলেরই জানা। মানুষ তাদের নাম উচ্চারণ করে কাউকে অপবাদ বা বিদ্রƒপ করার জন্য। জার্মানিতে এখনও হিটলারের কেউ প্রশংসা করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া হয়। অথচ এই হিটলারের শুরুটা হয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা দিয়ে। তার জাদুকরি বক্তৃতা শুনে জার্মানবাসী মুগ্ধ হয়ে যেতেন। তাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই হিটলারই স্বৈরাচারে পরিণত হয়ে জার্মানবাসীর কাছে চরম ঘৃণার পাত্র হয়েছিলেন এবং তাই হয়ে আছেন। শুধু জার্মানেই নয়, সারাবিশ্বেই তার নাম ঘৃণাভরে উচ্চারণ করা হয়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।