বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানবচরিত্রের একটি নেতিবাচক দিক হল প্রান্তিকতা। আকাক্সক্ষা পূরণে উল্লাস আর আশাভঙ্গে অতিরিক্ত বেদনাবোধ মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা। পছন্দের কিছু ঘটলে মানুষ আনন্দের সীমা অতিক্রম করে উল্লসিত হয়ে ওঠে। কখনো তা গর্ব ও অহংকারেও পর্যবসিত হয়। পক্ষান্তরে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মানুষ অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার হয়। এই উভয় প্রান্তিক প্রবণতা দূর করে ভারসাম্যের পথ অবলম্বন করার শিক্ষা দেয় কুরআনে কারীম। আল্লাহ তা’আলা বলেন : পৃথিবীতে এবং তোমাদের প্রাণের ওপর যে মসিবতই আসে, তা একটি কিতাবে (লওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ আছে, আমি তা সৃষ্টির বহু পূর্বেই। এটি আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ। (তোমাদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হল) যেন তোমরা যা হারাও বা না পাও তার জন্য মুশড়ে না পড়ো। এবং যা আল্লাহ তোমাদের দান করেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা হাদীদ : ২৩-২৪)।
এ আয়াত বলছে, পৃথিবীতে এবং মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে সবকিছু লওহে মাহফুযে লিখিত তাকদীর অনুযায়ীই ঘটে। কাজেই কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় অতিরিক্ত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মানবীয় দুর্বলতাবশত মনে তো কিছুটা কষ্ট জন্মেই থাকে। কিন্তু সেই কষ্টকে জিইয়ে রাখা কিংবা অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার হওয়া উচিত নয়।
বরং সবকিছুই আল্লাহর ফায়সালায় হয় এ বিশ্বাস মনে জাগরুক রেখে ধৈর্য্য ধারণ করা কর্তব্য। তদ্রূপ কোনো কিছুর অর্জনে স্বাভাবিক আনন্দবোধ মানুষের স্বভাবজাত। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু স্বাভাবিক আনন্দের স্তর পেরিয়ে উল্লসিত হওয়া এবং অর্জিত বিষয়কে শুধুই নিজের প্রচেষ্টার ফল মনে করার অবকাশ নেই। বরং অর্জিত বিষয় আল্লাহর দান ভেবে শোকর করা কর্তব্য। এটিই ভারসাম্যপূর্ণ পথ।
একটি হাদীসেও এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একদিন আমি নবীজী (সা.) -এর পেছনে সওয়ারিতে বসা ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন; বৎস! আমি তোমাকে কিছু কথা শেখাচ্ছি। তুমি আল্লাহকে হেফাজত করবে (অর্থাৎ তাঁর হুকুম আহকাম মেনে চলবে), তাহলে আল্লাহও তোমাকে হেফাজত করবেন। তুমি আল্লাহকে হেফাজত করবে, তাহলে তাঁকে তোমার সম্মুখে পাবে। যখন চাইবে তো আল্লাহর কাছে চাইবে। সাহায্য প্রার্থনা করবে তো আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে।
জেনে রেখ, যদি গোটা উম্মত (মানব জাতি) একজোট হয় তোমার কোনো উপকার করার জন্য, তারা তোমার কোনোরূপ উপকার সাধনে সমর্থ হবে না; শুধু ততটুকুই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা একজোট হয় তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য, তোমার কোনোরূপ ক্ষতিসাধনে সমর্থ হবে না; কেবল ততটুকুই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। (জামে তিরমিজী : ২৫১৬)।
এ হাদীস থেকেও আমরা শিক্ষা পাই, মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে তা পূর্ব থেকেই তকদীরে লিখিত আছে। কাজেই কোনো কিছু হারালে বা কাক্সিক্ষত কিছু না পেলে অতিরিক্ত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এই অপ্রাপ্তি আল্লাহর ফায়সালায়ই হয়েছে। তদ্রূপ কোনো কিছু অর্জিত হলে উল্লসিত হওয়ারও কিছু নেই। কারণ এই প্রাপ্তি কেবলই আমার প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং তা আল্লাহর দান।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট থাকা দরকার, আল্লাহ তা’আলা কার তকদীরে কী লিখে রেখেছেন; তা কারো জানা নেই। তকদীরে কী লেখা আছে, তার পেছনে পড়ার কোনো প্রয়োজনও নেই। মানুষের দায়িত্ব হল, নিষ্ঠার সঙ্গে আপন কর্তব্য-কর্ম করে যাওয়া। কারণ ইখলাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে গেলে আল্লাহ তার জন্য নেক কর্মের পথ খুলে দেন।
কুরআন কারীম বলছে : তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্ন রকমের। (কাজেই তার ফলাফলও বিভিন্ন)। সুতরাং যে আল্লাহর পথে অর্থসম্পদ দান করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে এবং উত্তম বিষয়কে (ইসলামকে) সত্য বলে স্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করব (তওফীক দেব) সহজতম বিষয় (নেক আমল এবং নেক আমলের পথ ধরে জান্নাত)। পক্ষান্তরে যে কৃপণতা করে, বেপরোয়া থাকে এবং উত্তম বিষয়কে (ইসলামকে) অস্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করব কঠিনতম বিষয় (জাহন্নাম)। (সূরা আললাইল : ৪-১০)।
বোঝা গেল, নিষ্ঠার সঙ্গে নেক কর্মে লেগে থাকলে আল্লাহ তার জন্য পুণ্যের পথ এবং পুণ্যের পথ ধরে জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। পক্ষান্তরে কেউ হঠকারিতা করে বিপরীত পথ অবলম্বন করতে চাইলে তার পথও রোধ করা হয় না। তাকে আপন গতিতে চলতে দেয়া হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।