বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দান করে খোঁটা দেয়া সম্পর্কে গত আলোচনায় কিছু কথা বলা হয়েছিল। আজ আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করা হলো। এক খোঁটার মধ্যে রয়েছে অনেক রকমের অপকারিতা।
এতে গ্রহীতাকে কষ্ট দেয়া হয়, পরিণতিতে নিজের দান বিফলে যায় এবং আল্লাহ তা’আলার কাছে এ দানের কোনো বিনিময় পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। উল্টো একে হাদীস শরীফে কঠিন পাপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি খোঁটাদানকারী সমাজের চোখেও মন্দ বলে বিবেচিত হয়। সমাজের মানুষের সামনে তার নিচু মানসিকতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। নিজেকে সে নামিয়ে আনে মহানুভবতার সুউচ্চস্তর থেকে নিচুতার গভীর খাদে। যে খোঁটা দেয়, সে নিজেকে বড় মনে করে আর গ্রহীতাকে তুচ্ছ মনে করে বলেই খোঁটা দেয়। অথচ কাউকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা অহমিকা ছাড়া আর কী! এমন তো হতেই পারে, বিপদগ্রস্ত কিংবা পার্থিব বিচারে সহায়সম্বলহীন একজন মানুষ আল্লাহ তা’আলার কাছে বিত্তবান সহযোগিতাকারীর চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়।
এমনকি আমাদের চারপাশের দেখা বাস্তবতাও এমন, টাকা-পয়সায় পিছিয়ে থেকেও কর্মে-গুণে-আচরণে-সামাজিকতায় এবং পড়াশোনায় সমাজের বিত্তশালীদের ছাড়িয়ে যায় অনেকে। শুধু টাকা-পয়সার জোরে কেনো এ বাহাদুরি? এ বাহাদুরি আর অহমিকাই আসলে এ কুকর্মের মূল, এ খোঁটাদানের শেকড়।
দান করে খোঁটা দেয়া একপ্রকার ধৃষ্টতাও। মুমিনের বিশ্বাস এমন হতেই হবে, আল্লাহ তা’আলা যদি মেহেরবানী করে আমাদের তাওফীক দেন, তবেই শুধু আমরা কোনো ভালো কাজ সম্পাদন করতে পারি। আল্লাহ তা’আলার তাওফীক পেলেই আমরা কোনো মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারি। আমাদের সকল ইবাদতের মতো দান-সদকাও এ বিশ্বাসেরই আওতাভুক্ত। এর বাইরে নেই কিছুই।
এ বিশ্বাস যদি কারো মনে জাগ্রত থাকে, তবে সে কি আর খোঁটা দিতে পারে? তার মনে তো থাকবে দয়াময় আল্লাহ তা’আলার প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতা যে, আল্লাহ তাকে একটি নেক কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন বলে। গ্রহীতাকে সে নিজের উপকারকারী মনে করবে। তার ভাবনায় সে নিজেই উপকার-গ্রহীতা। গ্রহীতাকে না পেলে সে দান করত কোথায়, এ ভাবনা তার মনে গ্রহীতার প্রতি সম্মান আরো বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কারো ধারণা যখন উল্টে যায়, সে যখন ভাবতে শুরু করে, নিজের টাকায় আমি তাকে উপকার করেছি, বিপদ থেকে বাঁচিয়েছি, তাকে সহযোগিতা করতে পারা আমার নিজের কৃতিত্ব, তখনই সে খোঁটা দেয়ার সাহস করে। তাই যদি হয়, তবে এ ভাবনা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী হতে পারে!
কেউ কাউকে সহযোগিতা করলে তাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়। আরবিতে প্রবাদ আছে, ‘আলইনসান আবদুল ইহসান’। অর্থাৎ মানুষ অনুগ্রহের দাস। তাই কাউকে অনুগ্রহ করলে, বিশেষ করে বিপদে সহযোগিতা করলে সে ‘দাস’ হয়েই যাবে। কিন্তু সহযোগিতাকারী যদি খোঁটা দেয়, তখন আন্তরিকতা বদলে যায় মনোমালিন্যে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দূরত্ব, সৃষ্টি হয় শত্রুতা। এক সময়ের উপকারের কথা ভুলে গিয়ে একে-অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। -এর মূলেও এই খোঁটা।
হ্যাঁ, মানুষের সমাজে কিছু মন্দ মানুষ থাকাও বিচিত্র নয়। এরা উপকারকারীর উপকার তো স্বীকার করবেই না, উল্টো তাদের ক্ষতি করার চেষ্টাও করতে পারে। তখন খোঁটা দেয়ার পরিবর্তে হাঁটতে হবে সবর ও ধৈর্য্যের পথে। মনে জাগরুক রাখতে হবে আমাদের দান ও সহযোগিতার চেতনা। কুরআনের ভাষায় : আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না। (সূরা দাহর : ৯)।
দান করে খোঁটা দেয়া যাবে না, বিষয়টি আসলে সহজ নয়। -এর জন্যে শুধু দান করার সময় নিয়তের বিশুদ্ধতা ও ইখলাসই যথেষ্ট নয়। লক্ষ্য যদি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কিছু হয়, তবে তা প্রথম ধাপেই ব্যর্থ। এমন দানকে ‘আল্লাহর পথে ব্যয়’ বলা যাবে না। বিশুদ্ধ নিয়তে দান করার পরই শুরু হবে সাধনার পরবর্তী স্তর। এ স্তরের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এ জীবনে কখনোই দানগ্রহীতাকে খোঁটা দেয়া যাবে না। নিজের অনুগ্রহের কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দেয়া যাবে না। যেখানে যে পরিবেশে দানগ্রহীতা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চায় সেখানে তা প্রকাশ করে দিয়ে তাকে বিব্রত করা যাবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।