Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে বড় আবিষ্কার নতুন ‘ফিউশন’ প্রযুক্তি

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ৫:৫৫ পিএম | আপডেট : ৭:২৯ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২

বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরেই স্বপ্ন দেখছিলেন এমন এক জ্বালানির উৎস আবিষ্কারের – যা কোনদিন ফুরিযে যাবে না, আর এর কোন পরিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়াও থাকবে না। তাদের মতে, একটি মাত্র উপায়েই এরকম এক জ্বালানির উৎস তৈরি করা সম্ভব – আর তা হচ্ছে ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’- যাকে বাংলায় বলা যায় ‘পারমাণবিক সংযুক্তি’।

বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরেই চেষ্টা করছিলেন কীভাবে এরকম একটা যুৎসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা যায়। সমস্যা হচ্ছে - এ প্রযুক্তি আবিষ্কারের পথে একটা বাধা ছিল। অবশেষে এই মঙ্গলবার মার্কিন বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন যে এরকম এক প্রযুক্তি আবিষ্কারের পথে যে বড় বাধাটি এতদিন তাদের আটকে রেখেছিল - সেটা অতিক্রম করতে পেরেছেন তারা। বাধাটা কী? সমস্যাটা ছিল দুটি পরমাণুর সংযুক্তি বা ফিউশন ঘটাতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হচ্ছিল – ফিউশন থেকে পাওয়া যাচ্ছিল তার চেয়ে অনেক কম শক্তি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন এই সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া গেছে।

‘ফিশন’ আর ‘ফিউশন’- পরমাণু শক্তি পাবার দুই চাবিকাঠি। অনেকেই জানেন পরমাণু হচ্ছে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা যা তিনটি আরো ক্ষুদ্র উপাদান দিয়ে গঠিত – ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হয় পরমাণুর কেন্দ্র আর তার চারদিকে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। এই পরমাণুর কেন্দ্রটাকে যদি ভাঙা যায়, তাহলে যে শক্তি দিয়ে নিউট্রন আর প্রোটন একসাথে লেগে আছে – তা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আনে।

আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী এই শক্তির পরিমাণ বিপুল - অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ পদার্থের পরমাণু ভেঙে ফেললেও তা থেকে যে শক্তি বেরিয়ে আসবে তার পরিমাণ হবে প্রচণ্ড। এই পরমাণু ভাঙার প্রক্রিয়াকে বলে ‘ফিশন’ – এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে পারমাণবিক বোমা - সবগুলোর মূল ব্যাপারটা একই। পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে এই ফিশন ঘটানো হয় নিয়ন্ত্রিতভাবে – যাতে সৃষ্ট তাপ দিয়ে পানি গরম করে বাষ্পীয় টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুত তৈরি হয়। আর বোমার ক্ষেত্রে ফিশন হয় অনিয়ন্ত্রিত – তাই তা হয়ে ওঠে এক ভয়ংকর মারণাস্ত্র।

এবার ফিউশনের কথা। পারমাণবিক ফিউশন জিনিসটা হচ্ছে ফিশনের ঠিক উল্টো - যার অর্থ ‘জোড়া লাগা।’’ এখানে পরমাণুকে ভাঙা হয় না, বরং হাইড্রোজেন গ্যাসের দুটি পরমাণুকে অতি উচ্চ তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে জোড়া লাগানো হয় – যার ফলে নিউক্লিয়াসের ভেতরের বিপুল পরিমাণ শক্তি বাইরে বেরিয়ে আসে। সূর্য এবং অন্যান্য তারা থেকে যে প্রচণ্ড শক্তি অবিরাম নির্গত হচ্ছে – তা ঘটছে এই ফিউশন প্রক্রিয়ার ফলেই। এ শক্তি ব্যবহার করে যদি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা যায় – তাহলে প্রায় কোন পরিবেশগত ক্ষতি না করেই অনিঃশেষ পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

এ নিয়েই বহু দশক ধরে গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এতকাল তারা আটকে যাচ্ছিলেন একটা জায়গায় এসে। সমস্যাটা হলো- ফিউশন ঘটাতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হচ্ছিল – শক্তি উৎপাদন হচ্ছিল তার চেয়ে অনেক কম। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি (এলএল এনএল)-র বিজ্ঞানীরা বলছেন – তারা এমন এক পদ্ধতি বের করতে পেরেছেন যাতে ফিউশন ঘটাতে যে পরিমাণ শক্তি লাগছে – পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি শক্তি।

জ্বালানি বা বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই নিউক্লিয়ার ফিউশনকে মনে করা হয় এমন এক বহুকাঙ্খিত লক্ষ্য বলে -যা অনেকেই সম্ভব করতে চেয়েছেন কিন্তু কেউ পারেননি। কারণ হলো – ফিশন প্রযুক্তিতে আজকালকার যেসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে, তাতে প্রচুর পরিমাণ তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন হয় – যা নিরাপদভাবে মজুদ করে না রাখলে বিপদের কারণ হতে পারে।

অন্যদিকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের ফলে অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন সম্ভব এবং এর ফলে যে বর্জ্য তৈরি হয় তার পরিমাণ সামান্য, আর তা খুব বেশি দিন তেজষ্ক্রিয় থাকে না। এর ফলে কোন গ্রিনহাউজ গ্যাসও নির্গত হয় না, ফলে জলবায়ু পরিবর্তনকেও তা ত্বরান্বিত করে না। ক্যালিফোর্নিয়ার এলএলএনএল-এর ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটিতে এ পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এল এল এন এল-এর পরিচালক ড. কিম বাডিল বলছেন, ‘এটি এক ঐতিহাসিক অর্জন। গত ৬০ বছর ধরে হাজার হাজার লোক এই প্রয়াসে অবদান রেখেছেন, এবং এ পর্যন্ত আসতে অনেক উদ্ভাবনীক্ষমতার প্রয়োজন হয়েছে।’

মনে রাখতে হবে যে পদার্থের পরমাণুর দুই উপাদান প্রোটন আর নিউট্রনকে যে শক্তি একসাথে বেঁধে রেখেছে - তা এক প্রচণ্ড শক্তি। ফিউশন প্রযুক্তিতে হাইড্রোজেন ব্যবহার হয় – কারণ হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা মৌলিক পদার্থ এবং এর পরমাণুর গঠনও সবচেয়ে সরল। সাধারণতঃ একটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি মাত্র প্রোটন আর একটি ইলেকট্রন থাকে – খুব বিরল ক্ষেত্রে একটি দুটি নিউট্রন থাকতে পারে। কিন্তু দুটি হাইড্রোজেনের পরমাণুকে জোড়া লাগানো এবং তাকে সেই যুক্ত অবস্থায় ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন। এ জন্য দরকার হয় অতি উচ্চ তাপ এবং প্রচণ্ড চাপ। এতদিন পর্যন্ত কোন পরীক্ষাতেই সে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করে তার চেয়ে বেশি শক্তি বের করে আনা সম্ভব হয়নি।

ক্যালিফোর্নিয়ার এই ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি হচ্ছে সাড়ে তিনশ কোটি ডলারের এক পরীক্ষা প্রকল্প। পরীক্ষাটা হচ্ছে এই রকম – একটা গোলমরিচের দানার সমান একটা ক্যাপসুলের মধ্যে সামান্য পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা হয়। এর পর একটা অত্যন্ত শক্তিশালী লেজার রশ্মি দিয়ে একে উত্তপ্ত করা হয় এবং চাপ প্রয়োগ করা হয়। এ লেজার প্রচণ্ড শক্তিশালী। এটা প্রয়োগ করায় ক্যাপসুলটি এত গরম হয়ে যায় যে তার তাপমাত্রা হয় ১০০,০০০,০০০ বা ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রা সূর্যের কেন্দ্রস্থলের চেয়েও বেশি। তাপের সাথে প্রয়োগ করা হয় চাপ। এ চাপের পরিমাণ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের চাইতে ১০,০০০ কোটি গুণ বেশি। এই প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে ক্যাপসুলটির ভেতরে থাকা হাইড্রোজেনের পরমাণুগুলো একটি আরেকটির সাথে জোড়া লেগে যেতে থাকে – আর সেই সাথে বেরিয়ে আসতে থাকে তাদের ভেতরকার শক্তি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রতিরক্ষা কর্মসূচির উপ-প্রশাসক ড. মার্ভিন অ্যাডামস এই আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন, ‘এই ল্যাবরেটরির লেজারগুলো হাইড্রোজেন ক্যাপসুলের ওপর ২.০৫ মেগাজুল (এমজে) পরিমাণ শক্তি নিক্ষেপ করেছে এবং তার পর ফিউশন থেকে যে শক্তি পাওয়া গেছে তার পরিমাণ ৩.১৫ মেগাজুল।’ ফিউশন এনার্জি ইনসাইটস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ড. মেলানি উইন্ড্রিজ বিবিসিকে বলেন, ‘সূর্য কেন এত উজ্জ্বল তা যেদিন বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন সেদিন থেকেই তারা ফিউশনের কথা ভাবছিলেন। আজকের এই ফলাফল আমাদেরকে সত্যি সত্যিই এ প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহারের পথে তুলে দিয়েছে।’ ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের প্লাজমা ফিজিক্সের অধ্যাপক জেরেমি চিটেন্ডেন বলেন, এতে প্রমাণ হলো – যে লক্ষ্যের কথা আমরা এতদিন ভেবেছি তা সত্যিই অর্জন করা সম্ভব।

ফিউশন প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাহলে কবে দেখা যাবে? এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। কারণ শত শত কোটি ডলারের এই পরীক্ষায় যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়েছে তা দিয়ে ১৫-২০ কেটলি পানি গরম করা যাবে মাত্র – এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ পরীক্ষায় যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে – তার চেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়েছে। এটা একটা সাফল্য ঠিকই, কিন্তু লেজারগুলোকে চালাতে যে শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে তা এই হিসেবে ধরা হয়নি। তার পরিমাণ কিন্তু হাইড্রোজেন থেকে পাওয়া শক্তির চেয়ে বেশি।

তার মানে হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে এ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হলে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে, আর এর খরচও কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে এই প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র অবধি পৌঁছাতে তাহলে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? এলএলএনএলের পরিচালক ড. বাডিল বলছেন, সেপর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এখনো অনেক বাধা রয়ে গেছে। তার কথা – ‘সমন্বিত প্রয়াস এবং বিনিয়োগ পেলে এ সংক্রান্ত প্রযুক্তির ওপর আরো কয়েক দশকের গবেষণার পর আমরা হয়তো একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির অবস্থানে পৌঁছাতে পারবো।’

তাহলে? এ পরীক্ষা থেকে আসলে কি লাভ হলো? বিবিসির রেবেকা মোরেল বলছেন, উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ সামান্য হলেও এ পরীক্ষা থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তার মূল্য বিরাট। তিনি বলছেন, এ পরীক্ষাতে বোঝা যাচ্ছে যে এটা কাজ করবে তবে আরো অনেক দূর যেতে হবে। ‘এ পদ্ধতিকে বার বার পরীক্ষা করতে হবে, নিখুঁত করতে হবে, উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে, তার পরই বৈজ্ঞানিকরা এটাকে বড় আকারে করার কথা ভাববেন।’ সূত্র: বিবিসি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ