বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা আমাদের আদেশ করেছেন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং কোনো কিছুকে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না। আর সদাচরণ করো বাবা-মায়ের সঙ্গে এবং আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সঙ্গেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা নিসা : ৩৬)।
এই আয়াতে আমাদের যেমন লা-শারিক আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হচ্ছে, একই গুরুত্বের সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচারের আদেশও করা হচ্ছে। আর বাবা-মায়ের পাশাপাশি উল্লেখিত হয়েছে আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকীন, প্রতিবেশীসহ আরো কতজন। আদেশ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের। সুন্দর আচরণ বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকিÑ তাদের বিপদে সহযোগিতা করতে হবে, তাদের সঙ্গে কোনো মন্দ আচরণ করা যাবে না ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, এগুলোও সুন্দর আচরণ।
কিন্তু কেবল এগুলোই নয়, সুন্দর আচরণের সীমা আরো বিস্তৃত। সুন্দর আচরণ করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কেউ যখন কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান করে, তখনো সে চায়Ñ তার কাছের সবাইকে নিয়ে সে আনন্দ উদযাপন করবে। আবার তার ঘনিষ্ঠ যারা তারাও আশা করে, তাদের সঙ্গে নিয়েই সে অনুষ্ঠান করবে। একে অন্যের কাছে এটা সামাজিকতার দাবি, ঘনিষ্ঠতার দাবি। শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসারে উভয়েরই এ দাবি রক্ষা করা উচিত। কাছের কেউ যখন কোনো আমন্ত্রণে সাড়া না দেয় কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানায়, তখন আমরা অনুভব করি এর গুরুত্ব।
তাই বিয়ে-শাদিসহ এরকম কোনো অনুষ্ঠানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত কিংবা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো সঙ্কট না থাকে, তখন ওই আমন্ত্রণ সে রক্ষা করবেÑ এটাই ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও দেখুন। প্রিয় নবীজী (সা.)-এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন : যে ওলিমায় কেবল ধনীদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয় আর গরিবদের বর্জন করা হয়, সে ওলিমার খাবার নিকৃষ্ট খাবার। আর যে আমন্ত্রণ রক্ষা করে না, সে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের অবাধ্য হলো। (সহীহ বুখারী : ৫১৭৭)।
এই হাদিস থেকে আমরা দু’টি বার্তা পাই। এক. কেউ যখন বিয়ে-পরবর্তী ওলিমার আয়োজন করবে, তখন সেখানে বেছে বেছে কেবল ধনীদেরই আমন্ত্রণ করবে না, বরং ধনী আত্মীয়, ধনী প্রতিবেশী আর ধনী বন্ধু-বান্ধবের পাশাপাশি তুলনামূলক অসচ্ছল গরিব আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরও দাওয়াত করবে। আর যদি কাউকে কেবল এ জন্যই আমন্ত্রণ জানানো না হয় যে, সে গরিব, তাহলে সে ওলিমার খাবার হবে নিকৃষ্ট খাবার!
দুই. কাউকে যখন এমন কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়, সে যেন তাতে শরিক হয়। তাতে অংশগ্রহণ না করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে অবাধ্যাচরণ করারই নামান্তর। আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের পাঁচটি অধিকার- ১. সালামের জবাব দেয়া, ২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, ৩. জানাজায় শরিক হওয়া, ৪. দাওয়াত করলে তা রক্ষা করা, ৫. হাঁচির জবাবে দুআ পড়া। (সহীহ বুখারী : ১২৪০)। তাই আমন্ত্রণ রক্ষা করা কেবল সামাজিকতার দাবিই নয়, এ দাবি বরং মুমিনের কাছে ঈমানের দাবি।
অনেকে আবার অসচ্ছলদের দাওয়াতকে পরোয়া করেন না। অথচ নৈতিকতার দাবি হলো, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা কারো দাওয়াতেই অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সাড়া দেয়া উচিত। প্রিয় নবীজী (সা.)-এর প্রিয় জীবনাদর্শ আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। তাঁকে যখন কেউ আমন্ত্রণ করত, তিনি সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। আমন্ত্রণকারী ধনী না গরিব, সচ্ছল না অসচ্ছল, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না কোনো সাধারণ ব্যক্তিÑ এসব বিষয় তিনি মোটেও লক্ষ করতেন না। তিনি স্পষ্ট বলেছেন : আমাকে যদি (বকরির পায়ের) মাংসবিহীন চিকন হাড় খেতেও দাওয়াত করা হয় তবুও আমি সে দাওয়াত রক্ষা করব। (সহীহ বুখারী : ৫১৭৮)।
হ্যাঁ, যদি আমন্ত্রণ রক্ষা করায় কোনো সঙ্কট থাকে, যেমনÑ আমন্ত্রণকারী আয়-উপার্জনে হালাল-হারামের বিবেচনা না করে, আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে উল্টো আরো কিছু গোনাহে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয় কিংবা অসুস্থতা বা অন্য কোনো বাস্তব সমস্যা, তাহলে সেখানে অংশগ্রহণ না করার সুযোগ রয়েছে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সে দাওয়াতে না যাওয়াটাই অধিক কাক্সিক্ষতও হতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।