বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মানুষকে সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও মঙ্গল কর্ম সম্পাদনের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি প্রদান করেছেন এবং তাদের তা অবিচল চিত্তে প্রতিপালনের জন্য বার বার আহ্বান করেছেন। এতদ প্রসঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : (হে প্রিয় নবী (সা.)! সুতরাং আপনি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন তাতে অবিচল থাকুন এবং আপনার সাথে যারা তাওবাহ করেছে তাঁরাও। এবং তোমরা সীমালংঘন করো না। তোমরা যা করো নিশ্চয়ই তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা হুদ : আয়াত-১১২)।
এই আয়াতে কারীমায় অবিচলতা তথা ইস্তেকামাত শব্দের উল্লেখ একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ইস্তেকামাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ডান বা বাম কোনো দিকে একটু পরিমাণ না ঝুঁকে একদম সোজাভাবে থাকা। (তাফসিরে কুরতুবী)। আর ইস্তেকামাত শব্দের ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশাবলি যথাযথভাবে অবিচল দৃঢ়তা ও সাধনার মাধ্যমে প্রতিপালন করা, যাতে নির্দেশের হক পুরোপুরি আদায় হয়। মূলত এটা সহজ কাজ নয়। উল্লেখিত আয়াতে কারীমায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সকল মুসলিমকে তাদের সকল কাজে সর্বাবস্থায় উস্তেকামাত অবলম্বনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে ইস্তেকামাত শব্দটি ছোট হলেও এর অর্থ ও মর্ম অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। কেননা, সর্বাবস্থায় দ্বীনের পথে সঠিকভাবে চলার অর্থ হচ্ছে, ঈমান, আকায়িদ, ইবাদত, লেন-দেন, আচার-ব্যবহার, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থ উপার্জন ও ব্যয় তথা নীতি-নৈতিকতার যাবতীয় ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে থেকেই তার নির্দেশিত সোজা পথে চলা সহজ কাজ নয়। তন্মধ্যে কোনো ক্ষেত্রে কোনো কাজে এবং পরিস্থিতিতে গড়িমসি করা, বাড়াবাড়ি করা অথবা ডানে-বামে ঝুঁকে পড়া ইস্তেকামাতের পরিপন্থী ও বিপরীত।
এই দুনিয়ায় যত গোমরাহী ও পাপাচারের ঢল দেখা যায় তা সবই ইস্তেকামাত বা অবিচলতা হতে সরে যাওয়ার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। আকায়িদ তথা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইস্তেকামাত না থাকলে মানুষ নানারকম কুসংস্কার ও বিদআত হতে শুরু করে কুফুরী ও শেরেকী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আল্লাহ তায়ালার তাওহীদ, তাঁর পবিত্র সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) যে সুষ্ঠু ও সঠিক মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র হ্রাস-বৃদ্ধি বা পরিবর্ধন-পরিবর্জনকারী গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট রূপে আখ্যায়িত হবে। তাতে তাঁর নিয়ত যতই ভালো হোক না কেন। অনুরূপভাবে নবী ও রাসূলগণের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির যে সীমারেখা নির্ধারিত করা হয়েছে, সে ব্যাপারে ত্রুটি করা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতা ও ধৃষ্টতা।
তেমনিভাবে কোনো রাসূলকে আল্লাহর গুণাবলি ও ক্ষমতার মালিক বানিয়ে দেয়াও চরম পথভ্রষ্টতা। ইহুদি ও নাসারারা এহেন বাড়াবাড়ির কারণেই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়েছে। ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার জন্য কুরআনুল কারীম নির্দেশিত এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রদর্শিত পথের মধ্যে কোনোরূপ কমতি বা গাফিলতি মানুষকে যেমন ইস্তেকামাত এর আদর্শ হতে বিচ্যুত করে, অনুরূপভাবে দ্বীনের মধ্যে নিজের পক্ষ হতে কোনো বাড়াবাড়ি বা পরিবর্ধন ও মানুষকে বিদআত বা নব সংযোগ পাপাচারে লিপ্ত করে। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় উম্মতকে বিদআত ও নিত্যনতুন সৃষ্ট পথ ও মত হতে অত্যন্ত জোরালোভাবে নিষেধ করেছেন এবং বিদআতকে চরম গোমরাহী বলে অভিহিত করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৬০৭)।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে, যখন সে কোনো কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির লাভের জন্য ইবাদাত হিসেবে সম্পন্ন করতে চায়, তখন সে কাজ করার পূর্বে পূর্ণ তাহকীক করে জানতে হবে সে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম উক্ত কাজ ঐভাবে করেছেন কি না? যদি না করে থাকেন, তবে উক্ত কাজে নিজের শক্তি ও সময়ের অপচয় করা কখনো ঠিক হবে না।
কারণ, আকায়িদ ইবাদাত, মুয়ামালাত আখলাক ও আচার-ব্যবহার তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীম নির্দেশিত মূলনীতিগুলোকে রাসূলুল্লাহ (সা.) বাস্তবে রূপায়িত করে একটা সুষ্ঠু সঠিক মধ্যম পন্থার পত্তন করেছেন। বন্ধুত্ব, শত্রুতা, ক্রোধ, ধৈর্য, মিতব্যয় ও দানশীলতা, জীবিকা উপার্জন, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা, আবশ্যকীয় উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা এবং ফলাফলের জন্য আল্লাহ পাকের অনুগ্রহের প্রতি তাকিয়ে থাকা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে মুসলিমদের এক নজিরবিহীন মধ্যম পন্থা দেখিয়ে দিয়েছেন। তা পুরোপুরি অবলম্বন করেই মানুষ সত্যিকার মানুষ হতে পারে। এ থেকে বিচ্যুত হলেই সকল ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।