বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আযান শুধু কয়েকটি শব্দের নাম নয়। আযানের মধ্যে রয়েছে ধ্বনির সাথে বাণী, রয়েছে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, রয়েছে তাওহীদের বিচ্ছুরণ এবং রয়েছে আত্মনিবেদন ও আত্মকল্যাণের এক হৃদয়ভেদী অনুরণন। এমন বহুমুখী অর্থবহ মর্মস্পর্শী ও সুউচ্চ আহবাননধ্বনি পৃথিবীর কোনো ধর্মে বা কোনো জাতির মধ্যে নেই। ১ম হিজরি সনে আযান চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি তা প্রতি মুহূর্তে ধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে অবিরামভাবে অপ্রতিহত গতিতে।
আহ্নিক গতির কারণে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর প্রতি স্থানে সর্বদা নামাজের সময় পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে আযানের সময়ের। ফলে পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা প্রতিটি মিনিটে ও সেকেন্ডে আযান উচ্চারিত হচ্ছে। আর সেই সাথে ধ্বনিত হচ্ছে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যবাণী এবং উচ্চকিত হচ্ছে সর্বত্র আল্লাহর মহত্ত ও বড়ত্বের অনন্য ধ্বনি। যার সাক্ষী হচ্ছে প্রতিটি সজীব ও নির্জীব বস্তু ও প্রাণী। এমনকি পানির মধ্যে বিচরণকারী মৎস্যকুল।
সম্প্রতি জার্মানিতে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে আযান প্রদানের অনুমতি দেয়া হয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সেখানে যখন প্রথম লাউডস্পিকারে প্রকাশ্যে আযান প্রদান করা হয়, আশে-পাশের মুসলিম-অমুসলিম প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক গভীর প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আর চলমান ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করে কাতারতো ইতোমধ্যেই ইসলামী সংস্কৃতিকে উপস্থাপনের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি নতুন স্টেডিয়ামে আযানের সুরকে আরো বেশি চমৎকারভাবে উপস্থাপনের জন্য বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা করেছে। নামাজের সময়ে সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় যখন সুরেলা কন্ঠে আযান শোনানো হয়, তখন স্টেডিয়াম জুড়ে এক পিন-পতন নীরবতা নেমে আসে। এক ভিডিওতে দেখা গেছে, স্থানীয় এক ইমাম সাহেব ইংল্যান্ড থেকে আগত এক দম্পতিকে মসজিদের পাশে আযান শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতে দেখেন। অতঃপর তাদেরকে মসজিদের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার সঙ্গে খুব সুন্দর আচরণ করা হয়। নামাজের বিষয়গুলো স্বচক্ষে দেখানো হয়। আযানের মতো এত হৃদয়গ্রাহী আবেদন সে আর কখনো শুনেনি।
আযান শুধুমাত্র একটি নামাজের ডাকই নয়, এটি একটি ভিন্নমাত্রার দাওয়াত। আযানের প্রতিটি শব্দ সুরতরঙ্গে এক উতলা আহবান। কাতার সরকার এই আযানকে আরো চমৎকার করে বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে তার দেশে আসা নানা ধর্মের মানুষদের মধ্যে শোনানোর ব্যবস্থা করেছে। বাছাইকরা শ্রেষ্ঠ মুয়াজ্জিনদের নিয়োগ দিয়েছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে বসফরাসের পাড়ে দাঁড়িয়ে ২০১৯সালের এপ্রিল মাসে যখন প্রথম আযান শুনেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল, এই বুঝি জীবনের প্রথম আযান শুনছি।
গোজলতেপে জামি, সুলতান আহমদ মস্ক, সুলতান সোলায়মান মস্ক প্রতিটি মিম্বর থেকে শত শত বছর ধরে একই সুরে আযানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে আসছে। ইস্তাম্বুলকে বলা হয় মসজিদের শহর। সেখানে প্রতিটি মসজিদে একই সুরে মুয়াজ্জিনগণ আযান দিয়ে থাকেন। মুয়াজ্জিনদেরকে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিয়োগ দেয়া হয়। যে কোনো লোক মসজিদে আযান দিতে পারে না। তুরস্কে আযানের জন্য বিশেষ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বাংলাদেশে মুয়াজ্জিনদের আযানের মধ্যে নানা সুর, নানা ঢং অনেক সময় আযানের প্রকৃত আবেদনকেই ব্যহত করে।
আমাদের দেশে আযানের জন্য মুয়াজ্জিনদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। হৃদয়গ্রাহী করে কীভাবে আযানকে আরো বেশি সুমধুর স্বরে উপস্থাপন করা যায়, প্রয়োজনে তার ব্যবস্থা করা। আযান কতটা হৃদয়ের গভীরতর জায়গায় রেখাপাত করে তার কিছুটা হলেও আমাদের অন্যতম কবি কায়কোবাদ তার ‘আযান’ কবিতায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেছেন :
‘কি সুধা ছড়িয়ে দেয় ঊষার আযানে!
জাগাইতে মোহমুগ্ধ মানব সন্তানে।
আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।