পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : পৃথিবীর যে দেশে মানুষ জন্ম নেবে সেটাই তার রাষ্ট্র। ব্যতিক্রম শুধু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বেলায়। ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান নিজ দেশে পরবাসী হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। তাদের যন্ত্রণা হাহাকারের দৃশ্য তাকিয়ে দেখছে বিশ্ববিবেক। মহাকবি আলাওল পদ্মাবতী কাব্যে মিয়ানমারের নাগরিকদের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে ‘আরবী, মিশরী, সামী, তুর্কী, হাবসী, রুমী, খোরসানী, উজবেগী, লাহোরী, মুলতানী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দি, কামরূপী, বঙ্গদেশী শেখ, সৈয়দজাদা, মোগল, পাঠান, যুদ্ধা, রাজপুত, হিন্দু নানা জাতির বসবাস’। মিয়ানমারে একশ’ ৩৬ জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সবার রাষ্ট্র আছে শুধু রোহিঙ্গাদের কোনো রাষ্ট্র নেই! গেরুয়া পোশাকের কট্টর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে রোহিঙ্গারা ‘দেশহারা’। প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গারা পৃথিবীর নাগরিক; তাদের দেশ থাকবে না কেন? মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ইহুদিদের জন্য ‘ইসরাইল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য আরাকানে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হচ্ছেনা কেন? মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, আসিয়ান, জাতিসংঘ কী ঘুমিয়ে থাকবে? মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘নাগরিক’ মেনে না নিলে বিশাল ওই জনগোষ্ঠীর ‘রাষ্ট্র’ করে দেয়া কী বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্বে পড়ে না? ইহুদিদের জন্য যা সম্ভব; মুসলমানদের জন্য সেটা অসম্ভব! রোহিঙ্গারা মুসলমান এটাই কী তাদের অপরাধ?
পৃথিবীতে ইসরাইল নামে কোনো দেশ ছিল না। ইহুদিদের বসবাসের জন্য ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ও মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে ১৮৯৭ সালে থিয়োডর হার্জেল নামের এক ইহুদি সুইজারল্যান্ডে বসে ‘বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। হার্জেল ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির করেন। সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীদের চক্রান্তে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ওই সময় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে। ইহুদিদের প্রতি ব্রিটিশরা সমর্থন দেয়ায় ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী সরকার গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করে। ১৯১৭ সালে উপনিবেশবাদী ব্রিটেন ও বিশ্ব ইহুদিবাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। ১৯১৮ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসংঘ ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটেনের একাধিপত্যকে স্বীকৃতি দেয়। ৩ দশক ধরে ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল ফিলিস্তিন। গোটা বিশ্ব থেকে ব্রিটিশ যখন পাততালি গোটায় তখন মধ্যপ্রাচ্যের পেটের ভিতরে তারা ইসরাইল নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটেনের কারণেই মূলত ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনকে ভাগ করার ইশতেহার প্রকাশ করে। ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। এক অংশ দেয়া হয় ইহুদিদের। জাতিসংঘের ওই ইশতেহারে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য ফিলিস্তিনের মোট ভূখ-ের অর্ধেক বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের মোড়লদের ইহুদিপ্রীতির কারণে আজও ফিলিস্তিন ভূখ-ে মোতায়েন রয়েছে ইহুদিবাদী বাহিনী। জাতিসংঘের একপেশে ইশতেহারের পক্ষে ভোট দেয় আমেরিকা, ব্রিটেনসহ ৩৩টি দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয় ১৩টি দেশ এবং ভোটদানে বিরত থাকে ১০ দেশ। ইশতেহার প্রকাশের এক বছর পর ফিলিস্তিন অংশটিও ইহুদিরা দখল করে নেয়।
ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয় মিয়ানমারের আরাকান এক সময় মুসলমানদের আধিপত্যই ছিল। ১৪০৪ সালে আরাকানের বৌদ্ধধর্মী যুবরাজ নরমিখলা ২৪ বছর বয়সে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজধানী ছিলো লেম্ব্রো নদীর তীরে লংগ্রেত। নরমিখলা এক সামন্তরাজার বোনকে অপহরণ করেন। এতে আরাকানের সামন্তরাজারা একত্রিত হয়ে বার্মার রাজা মেঙশো আইকে আরাকান দখলের অনুরোধ জানান। ১৪০৬ সালে বার্মার রাজা ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকান আক্রমণ করলে নরমিখলা পালিয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে সুফী হযরত মুহম্মদ জাকির রহমতুল্লাহ’র দরবার শরীফ-এ আশ্রয় নেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুহম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। ২৪ বছর পর ১৪৩০ সালে গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহ মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে ২০ হাজার সৈন্যবাহিনী দিয়ে নরমিখলাকে স্বীয় রাজ্য আরাকান উদ্ধারে সাহায্য করেন। গৌড়ীয় সৈন্যের সহায়তায় নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ আরাকান পুনরুদ্ধার করে নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গোপসাগরে উপকূলে গড়ে ওঠে এক নতুন সভ্যতার। এভাবে আরাকান মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৪৩০ সাল থেকে ১৫৩০ সাল পর্যন্ত আরাকান গৌড়ের সুলতানদের খাজনা দিত। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কিছু সময় বাদ দিলে আরাকান ছিল ম্রাউক-উ রাজবংশের শাসনাধীন। প্রত্যেক রাজা নিজেদের বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নাম ব্যবহার করতেন। রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা ছিল ফারসী। গৌড়ের মুসলমানদের অনুকরণে মুদ্রা প্রথার প্রবর্তন হয়। মুদ্রার একপিঠে রাজার মুসলিম নাম এবং অপর পিঠে আরবি হরফে লেখা ছিল মুসলমানদের কলেমা। রাজার সৈন্যবাহিনীতে অফিসার থেকে সৈনিক পদে নেয়া হতো মুসলমানদের। মন্ত্রী পরিষদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান এবং কাজী নিয়োগ করে বিচারকার্য পরিচালিত হতো। অপর এক রাজা সেলিম শাহ বার্মার মলমিন থেকে বাংলার সুন্দরবন পর্যন্ত বিরাট এলাকা দখল করে দিল্লির মোঘলদের অনুকরণে নিজেকে বাদশাহ উপাধিতে ভূষিত করেন।
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় শাহপরী দ্বীপের কাছেই আরাকানের মংডু শহরের পাশে সুউচ্চ দুটি পাহাড় চূড়ার নাম হানিফার টংকী এবং কায়রা পরীর টংকী। জনশ্রুতি আছে ইসলামের এক খলিফার ছেলে হযরত মুহম্মদ হানিফা আরাকানে আসেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় আরব বণিকরা ব্যবসা করতেন। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা আরাকান দখল করলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগরা পালিয়ে আসে। অত্যাচার থেকে বাঁচতে মগদের সাথে রোহিঙ্গা মুসলমানরাও চলে আসে কক্সবাজার। মগেরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় গভীর জঙ্গলে আর মুসলমানেরা সমুদ্র পথে এসে আশ্রয় নেয় স্বধর্মীয় চট্টগ্রামের মুসলমানদের কাছে। এটাই কী রোহিঙ্গাদের অপরাধ? এখন মগদের সঙ্গে নিয়ে বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন করছে।
মুসলিমরাই এক সময় মিয়ানমারের শাসন করতো। সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে ১৯৮৯ সালে আরাকান রাজ্যের নাম বদলে রাখাইন প্রদেশ এবং বার্মার নামকরণ করা হয় মিয়ানমার। মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে অবর্মী ও অবৌদ্ধ বলে অভিহিত করে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বিদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাদের ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বার্মা থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়ন শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে তাড়িয়ে দিতে সেনাবাহিনী আবার ‘অপারেশন পাই থায়া’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। ১৯৯৪ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের দু’টির বেশি সন্তান নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১২ সালে রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে দাঙ্গায় এক হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। মুসলমানদের গ্রামগুলোতে আগুন দিলে ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের স্বীকৃত ১৩৫টি জাতি গোষ্ঠীর দেশের রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। ফলে আরাকানের এক সময়কার মুসলিম রাজশক্তির অংশ রোহিঙ্গারা হয়ে যান শরণার্থী। এ সংকট শুরু হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আরাকান দখলের পর থেকে। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকান স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী নেতা সিনপিয়ার মৃত্যুর দুইশ’ বছর পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সুরাহা হয়নি। প্রশ্ন হলো রোহিঙ্গাদের নিজস্ব রাষ্ট্র থাকবে না?
রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমার নাগরিকত্ব না দিলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় তো নতুন ‘রাষ্ট্র’ করে দিয়ে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করা। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। রোহিঙ্গারা মানুষ নয়; তাদের মানবাধিকার বলে কিছু নেই? মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ, প্রতিবেশি দেশ, ওআইসি, জাতিসংঘ কেউই নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। সবার উচিত সুচির ওপর চাপ দেয়া। রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নাও; নয়তো আরাকানের ভূমি তাদের ছেড়ে দাও। ১৯৪৮ সালে কয়েক হাজার ইহুদি ধর্মাবলম্বীর জন্য মধ্যপ্রাচ্যের পেটের ভিতর ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করা গেলে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় কেন? রোহিঙ্গাদের নিজস্ব দেশ কবে হবে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।