বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হিজরত মানে স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। এ চলে যাওয়াটা সাময়িক নয়, স্থায়ী। মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে মুসলমানরা যখন অতিষ্ঠ, রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন অনুসারী মুসলমানদের নিয়ে আল্লাহর হুকুমে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন। এ হিজরত ছিল তখন ঈমানের মানদণ্ড।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা তখন হিজরত না করে মক্কাতেই অবস্থান করছিল, তাদের সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআনের এ সতর্কবাণী : সত্যি, নিজেদের ওপর জুলুমরত অবস্থায় ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় (তাদেরকে) তারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অসহায় ছিলাম। তারা বলে, আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করবে? এদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম, তা এক নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল! (সূরা নিসা : ৯৭ )।
অষ্টম হিজরি সনে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন হিজরতের এ আবশ্যিকতা রহিত হয়ে যায়। কিন্তু এর আগে যখন মুমিনদের জন্য মক্কা থেকে হিজরত করা জরুরি ছিল, উপরোক্ত আয়াতের বর্ণনা মোতাবেক হিজরত না করার শাস্তি অনিবার্য জাহান্নাম, তখন মুসলমানদের একজন হিজরত করেছিলেন ‘উম্মে কায়েস’ নাম্মী এক নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। এতে সে পরিচিত হয়ে পড়ে ‘মুহাজিরে উম্মে কায়েস’ নামে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এ হাদিসে এমন হিজরত সম্পর্কেই বলেছেন, পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার মানসে যে হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হবে না, এ হিজরত ইসলামের জন্য হিজরত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে না, এ হিজরতের মধ্য দিয়ে সে কেবল তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করেছে।
এ হচ্ছে নিয়তের কারিশমা। নিয়তের শুদ্ধতা যেন এক পরশপাথর। এর সংস্পর্শে লোহা পরিণত হয় স্বর্ণ-হীরা-মণিমুক্তায়, তুচ্ছ কোনো আমলও হয়ে ওঠে মহামূল্যবান, ফজিলতে-মর্যাদায় ভাস্বর। আর এ শুদ্ধতায় যখন ঘাটতি থাকে, মূল্যবান আমলও মূল্য হারাতে থাকে। এ ঘাটতি যে পরিমাণে হয়, আমলের মূল্যও ততটাই কমতে থাকে। সোনা হয়ে যায় মাটি, এমনকি আরো তুচ্ছ!
নিয়তের শুদ্ধতার পাশাপাশি কর্মপদ্ধতির শুদ্ধতাও যে জরুরি, এ প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণ দিই। তিন সাহাবী একদিন গেলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাড়িতে। তারা জানতে চাইলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) কেমন ইবাদত করেন? তাদের যখন বিষয়টি জানানো হলো, তখন তাদের দৃষ্টিতে ইবাদতের সে পরিমাণ যেন কম মনে হলো। তারা তখন নিজেরাই বলাবলি করল, তিনি তো আল্লাহর রাসূল! তাঁর আগের-পরের সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।
তাঁর সঙ্গে কি আর আমাদের তুলনা চলে?! এরপর তাদের একজন বলল, এখন থেকে আমি সারারাত কেবলই নামায আদায় করব। আরেকজন বলল, আমি সারা বছর রোযা রাখব। তৃতীয়জন বলল, আমি কখনোই বিয়ে করব না। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত হলেন।
তাদের তিনি বললেন : তোমরাই তো এমন এমন কথা বলছিলে, তাই না? শোনো, আল্লাহর কসম, আমিই তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তোমাদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বড় মুত্তাকী। অথচ আমি রোজা রাখি, রোজা ছাড়ি, (রাতে) নামায পড়ি, আবার ঘুমাই, আমি বিয়েও করি। তাই যে আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হয় সে আমার দলভুক্ত নয়! (সহীহ বুখারী : ৫০৬৩)।
হাদিসের বর্ণনায় কোনো জটিলতা নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে তিনজন সাহাবীকে এখানে তাঁর সুন্নত থেকে বিমুখ হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন তারা কেউই কোনো মন্দ চিন্তা বা ইচ্ছা করেননি। তারা একটু বেশি পরিমাণে ইবাদতই করতে চেয়েছিলেন। ইবাদতের মধ্যে নিজেদের সবটুকু সাধ্য বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর এক্ষেত্রে নিজেরা যেভাবে ভালো মনে করেছেন সেভাবেই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিকে শুধরে দিয়েছেন।
সংক্ষিপ্ত এ কথায় তাদের তিনি এ বার্তা দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে আমিই সর্বাধিক আল্লাহভীরু, তা সত্ত্বেও আমি সারা বছর লাগাতার রোজা রাখি না, সারারাত জেগে কেবলই নামায পড়ি না, আমি মাঝেমধ্যে রোজা ছেড়ে দিই, রাতে আমি বিছানায় যাই, আমি বিয়েশাদিও করেছি, অন্য সব মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনই আমি যাপন করি। তাই আল্লাহকে পেতে চাইলে, আমার দলভুক্ত থাকতে চাইলে তোমাদের সামনেও একই পথ। অধিক পরিমাণে ইবাদত করার জন্য বিয়ে না করা, নফল নামায পড়তে গিয়ে রাতে কখনোই না ঘুমানো, নফল রোজা বছরের কোনো দিনই বাদ না দেয়া। ইত্যাদি আমার পথ নয়।
এ হচ্ছে নিয়তের বিশুদ্ধতার পাশাপাশি যথার্থ কর্মপদ্ধতির অনিবার্যতার কথা। এ দুয়ের মাঝে আরেকটি বিষয়ও অপরিহার্য, সহীহ আমল। অর্থাৎ বিশুদ্ধ নিয়তে সহীহ আমলটি বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।