Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আজ ভয়াল ১২নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেনের তান্ডবের কালো রাত

বরিশাল ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০২২, ১১:২৪ এএম

দেশের বিশাল উপকূলীয় এলাকার সোয়া কোটি মানুষের কাছে ভয়াল বিভিষিকাময় ১২ নভেম্বর আজ। ১৯৭০-এ ১২ নভেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস নিয়ে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’ আড়াইশ কিলোমিটার বেগে উপক’লীয় জেলাগুলোর প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। সে ঝড়ের কালো রাতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নিখোঁজ থাকলেও তাদের বেশীরভাগেরই আর কোন সন্ধান মেলেনি। ফুসে ওঠা বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছাস লক্ষাধীক মানুষকে সমুদ্রের অতলে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা চলে যায় না ফেরার দেশে। বৃহত্বর বরিশাল ও পটুয়াখালী ছাড়াও লক্ষ্মীপুর সহ উপক’লের ১০টি জেলার বিশাল জনপদকে সে রাতে লন্ডভন্ড করে দিয়ছিল ভয়াল ঘূর্ণিঝড় । ’৭০-এর ১২ নভেম্বর হেরিকেন-এর আঘাতে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর উপক’ল বসবাসরত প্রতিটি পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিহত বা নিখোজ হয়েছিল।
উপকূলের ৭১০কিলোমিটার এলাকা যুড়ে সে রাতে যে ভয়াবহ বিভিষিকা নেমে এসেছিল তার নজির এখনো গোটা বিশ্বে বিরল। নভেম্বর এলেই গোটা উপক’লীয় এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে থাকেন। কারণ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের মত ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর রাতেও হেরিকেন-এর অনুরূপ আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বঙ্গোপসাগর থেকে বিশাল জলোচ্ছাস মাথায় করে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার বেগে বরিশাল, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের বিশাল এলাকায় হামলে পরেছিল।
বাংলাদেশের দক্ষিন সীমানা জুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গীনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংগ বঙ্গোপসাগরও। প্রকৃতির সাথে বঙ্গোপসাগরের বিচিত্র লীলার যে ভয়ঙ্কর রূপ, তার অস্তিত্ব অনুভব করতে গিয়ে বাংলাদেশের উপক’লবাশীকে বার বারই চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ পরবর্তি পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধরে ছোবল হানে। সে প্রকৃতির তান্ডব এদেশের উপক’লবাশীকে বার বারই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এমনকি প্রকৃতির এ রুদ্ররোসে আজ পর্যন্ত দেশের উপক’লভাগের কত মানুষ না ফেরার দেশে চলে গেছেন তার কোন সঠিক হিসেবও নেই। একইভাবে প্রকৃতির তান্ডবে উপক’লবাশীর সম্পদের ক্ষতির সীমাও অপরিসীম। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় বার বারই দেশের অর্থনীতিকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।
তবে ঘূর্ণিঝড় হেরিকেন-এর নির্মম অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে তোলা রেড ক্রিসেন্ট-এর ‘ঘূর্ণিঝড় প্রন্তুতি কর্মসূচী-সিপিপি’র প্রায় ৭৬ হাজার সেচ্ছাসেবী উপক’লবাশীকে সময়মত সতর্ক করা এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র সহ বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ফলে ’৭০-এর হেরিকেন পরবর্তি ঘূর্ণিঝড়গুলোতে প্রাণহানী আশাতীতভাবে হৃাস করা সম্ভব হচ্ছে।
বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তির কারন ও এর গতিপথ নির্ণয় সম্ভব হলেও তার নিয়ন্ত্রন আজো মানুষের সাধ্যের বাইরে। তবে সময়মত সতর্ক করার ফলে প্রাণহানী যথেষ্ঠ হৃাস করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি টেকশই অবকাঠামো নির্মানের ফলে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও কিছুটা হৃাস করা সম্ভব হলেও দক্ষিনাঞ্চল সহ উপক’লীয় কৃষি ব্যবস্থা এখনো প্রকৃতি নির্ভর। আর সে প্রকৃতি, কৃষি নির্ভর উপক’লের অর্থনীতিকে বারবারই বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ফলে ক্ষুধা আর দারিদ্রতা দক্ষিন উপক’লবাশীর পিছু ছাড়ছে না।
১৯৭০-এর ১২নভেম্বর কালো রাত্রীর সে বিভিষিকা আজো উপক’লের বয়োজেষ্ঠদের তারা করে ফিরছে। তবে স্বজনহারা সব বয়সী মানুষ বড় দুঃসহ জাতনা নিয়েই স্মরন করছেন ভয়াল ১২নভেম্বরকে। আজ হেরিকেন-এর ছোবলে নিহতদের স্মরনে ভোলা সহ উপক’লীয় বিভিন্ন এলাকায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
১২ নভেম্বরের হেরিকেনের তান্ডব গোটা উপক’লের শত শত মাইল যুড়ে শুধু বিধ্বস্ত জনপদে লাশের মিছিল আর জনবসতীর ধংশস্তুপের চিঞ্হ রেখে যায়। হাজার হাজার মানুষ ও গবাদী পশুর মৃতদেহ, আর তার পচা গলা দূর্গন্ধে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকেও চরম মানবিক বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছিল। তাদের পারনে ছিলনা কাপড়, পেটে ছিলনা খাবার। ছিলনা মাথা গোজারও কোন ঠাই। ফলে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছিল।
তারপরেও একের পর এক প্রকৃতির রুদ্র রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া উপক’লের মানুষগুলো প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই টিকে আছে আজো । তবে ’৭০-এর সেই স্মৃতি নিয়ে এখনো যারা বেঁচে আছেন, তাদের সকলকেই আজো তাড়া করছে ভয়াল সে স্মৃতি। এমনকি সে রাতে ভয়াল হেরিকেনের তান্ডবের শিকার নিকটজনের লাশও খুজে পায়নি হাজার হাজার পরিবার। পরিপূর্ণ ধংশস্তুপে পরিনত হয়েছিল দেশের পুরো উপক’লীয় জনপদ।
তবে ঐ দূর্যোগের পরেও পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাষক ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শনে এসেছিলের ১০দিন পরে। ততদিনে গোট বিশ্বের গনমাধ্যম সরেজমিনে হেরিকেনের তান্ডবের খবর বিস্তারিত প্রচার করে। বিশ্ব বিবেক পাকিস্তানের সামরিক শাষকদের ঐ অমানবিক আচরনেরও ধিক্কার জানায়। ঘূর্ণিঝড়ের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ভোলা সহ ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকার মানুষের পাশে ছুটে আসেন। দলীয় নেতা কর্মীদের নিয়ে ত্রান ও উদ্ধার তৎপড়তায় অংশ নেন ঐ দুই নেতা ।
সেদিন প্রকৃতির ভয়াল রুদ্র রোশের শিকার উপক’লীয় জনপদে অবশিষ্ট ছিল শুধু সাগরের গর্জন এবং মানুষ আর গবাদী পশুর শব মিছিল। আর বিভৎস ধংশস্তুপ থেকে ভেসে আসছিল শুধু স্বজন হারাদের কান্নার রোল। পানি, খাবার আর বসনের অভাবে উপক’লের বেশীরভাগ এলাকার বাতাসই দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে গিয়েছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ