Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভিযোগের বোঝা নিয়েই শেষ হচ্ছে জয়-লেখক যুগ

রাহাদ উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে বহিষ্কার করে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হয় এক নং সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও এক নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে। মাস তিনেক পরে ভারমুক্ত করে দলের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব তুলে দেয়া এই দুই নেতার হাতে। নির্দেশ দেয়া হয় দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। তবে শেষ সময়ে এসেও শৃঙ্খলা ফেরানোয় যোজন যোজন দূরে এই দুই নেতা। যে অভিযোগে ছাত্রলীগের আগের দুই নেতা বহিষ্কার হয়েছে বর্তমান দুই নেতার বিরুদ্ধে সেরকম শতাধিক অভিযোগ থাকলেও কোনোটাই আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলাফলে চরম দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ নিয়েই দীর্ঘ ৩ বছরের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে জয়-লেখক যুগের। আগামী ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের ৩০ তম সম্মেলনের মাধ্যমে শেষ হবে ছাত্রলীগের আরেক বিতর্কিত অধ্যায়।

এর আগে ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ থেকে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ আনেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলাম। এর পরপরই কমিটি বাণিজ্য, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, মাদকদ্রব্য সেবন, বিতর্কিত নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন, জেলা সম্মেলন করতে না পারা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের উপেক্ষা করা, ফোন না ধরাসহ একগুচ্ছ অভিযোগের বিষয়টি নতুন মাত্রা পায়। সবশেষে ব্যাপক সমালোচনার মধ্য দিয়ে ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর পদ হারায় ছাত্রলীগের ওই দুই শীর্ষ নেতা। তৈরি হয় ছাত্রলীগের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সংগঠনের হাল ধরেন নতুন দুই নেতা আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। তবে দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের বিদায় হলেও সে পথেই হেঁটেছেন নতুন দুই নেতা।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারমুক্ত হয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তির পর চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি শেষ হয় জয়-লেখকের মেয়াদকাল। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ মাসেও নতুন কমিটি দেয়ার প্রবনতা দেখা যায়নি সংগঠনটির নীতিনির্ধারকদের। এসময়ের মধ্যে সকল জেলা, উপজেলা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথা থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো কমিটিই দিতে পারেননি এই দুই নেতা। মেয়াদ শেষে শুরু হয় প্রেস-বিজ্ঞপ্তি ভিত্তিক কমিটি উৎসব।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি দুই মাসে একবার সভা ডাকার কথা থাকলেও দায়িত্ব প্রাপ্তির প্রায় তিন বছরে একটিও কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করতে পারেনি জয়-লেখক। মোট ১১৯টি জেলা ও জেলা সমমান ইউনিটের মধ্যে মাত্র ৩৮টি কমিটি দিতে পেরেছে তারা। জবাবদিহিতার ভয়ে কার্যনির্বাহী সভা এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। ৩৮টি কমিটিতে অছাত্র, বিতর্কিত, বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সন্তান, মাদকসেবীদের পদায়ন করারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। রয়েছে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ। আমলে নেয়া হয়নি একটি অভিযোগও। যে কয়টা কমিটি গঠন করতে পেরেছে সেগুলোর নেতাকর্মীদের সীমাহীন অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পেলেও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি তারা।

জেলা ও জেলা সমমনা ইউনিটগুলোর কমিটি দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সাথে সমন্বয় করার কথা থাকলেও কোনোরকম যোগাযোগ ছাড়াই এসব কমিটি দেয় জয়- লেখক। যা তাদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সংগঠনের গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে অধিক সংখ্যক নেতাকর্মীকে পদায়ন করা হয়েছে অনেক কমিটিতে। এসব বিষয়ে আলাপ করা হয়নি সংগঠনটির দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথেও। ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের একজন নেতা এ তথ্য ইনকিলাবকে নিশ্চিত করেছেন।

এসব বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি বলেন, বিশেষ ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে সভাপতি-সম্পাদকের এখতিয়ারে সদস্য পদায়ন করা যায়। গঠনতন্ত্রের মধ্যে থাকতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অনেক সক্রিয় নেতাকর্মী থাকায় গঠনতন্ত্রের অনুসরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। সাংগঠনিক গতিশীলতা ধরে রাখার জন্য অনেক ক্ষেত্রে সবার সাথে সমন্বয় করাও হয়ে উঠে না।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ছাত্রলীগের ১ নং ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ঘোষণার পর ৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রস্তুতি নেই সম্মেলনের। ফলে ত্যাগী নেতারা ধীরে ধীরে বাদ পড়ছেন বয়সের দৌঁড়ে। চতুর্মুখী চাপে হতাশায় আছেন হাজারো নেতাকর্মী।

ছাত্রলীগের এই দুই নেতার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ। সবশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে লিখিত অভিযোগ দেন কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশ। কিন্তু কোনো অভিযোগই আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের দুই কাণ্ডারির স্বেচ্ছাচারিতা, কেন্দ্রীয় নেতাদের অবমূল্যায়ন, সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের বিষয় উল্লেখ করা হয় ওই অভিযোগ পত্রে। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়। আগস্টে জাতীয় শোক দিবসের মাসে কেন্দ্রীয় কমিটি বর্ধিতকরণ, পদ-বাণিজ্য, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ছাড়া রাতের আঁধারে কমিটি গঠন, বিবাহিত, চাঁদাবাজ, মাদকসেবী, ছাত্রদল ও শিবিরকর্মীদের কমিটিতে পদায়ন, সাধারণ সভা না করা এবং সংগঠনের নিয়মভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ উল্লেখ করা হয় ওই অভিযোগপত্রে।

আগস্টে জাতীয় শোকের মাসে কেন্দ্রীয় কমিটি বর্ধিতকরণের নামে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৫০০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। পদায়িত নেতারা শোকের মাস আগস্টকে ভুলে গিয়ে আনন্দ উল্লাস ও অভিনন্দনে ফেটে পড়েন। যার প্রভাবে তৃণমূল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডে নিদারুণভাবে আহতবোধ করেন; যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক সমালোচনার জন্ম দেয়।

অন্তত ১০০ নেতার সই সম্বলিত ওই অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, আগস্টের শুরুতে পাঁচটি জেলা ইউনিটের নতুন কমিটি ও দুটি জেলা ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে মন্দির ভাঙার অপরাধে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি এবং ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত একজনকে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে পদায়ন করা হয়। বরগুনা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যোগ্যদের মূল্যায়ন না করে নিজেদের লোক দিয়ে কমিটি গঠন করার অভিযোগও রয়েছে এতে।

এতে আরো বলা হয়, সম্মেলন আসন্ন বিধায় গঠনতন্ত্রের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আর্থিক লেনদেন ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে রাতের অন্ধকারে একের পর এক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সম্মেলন থেকে ফেরার পথে মাদকসহ বিজয়নগর থানা পুলিশ ছাত্রলীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দুজন সহসভাপতিকে গ্রেপ্তার করে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল সংসদের এজিএস ও হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী দাস তন্নীকে মারধর করে মারাত্মক জখম করার অপরাধে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজীর হোসেন নিশি ও সহসভাপতি জেয়াসমিন শান্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। যা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। চার বছর চার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়নি এবং এ বিষয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তারা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি। বর্তমান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মেয়াদ চার বছর তিন মাস পার হয়েছে। এ অবস্থায় নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য এবং সংগঠনকে বিতর্কিত করতে সম্মেলন ছাড়া যাতে নতুন করে কোনো কমিটি করতে না পারে সে জন্য সংগঠনের অভিভাবকের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ বলেন, কাউকে শতভাগ সফল বা ব্যর্থ বলা যায় না। করোনাকালীন সময়ে ছাত্রলীগ মানবিক কাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেও তা ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সভাপতি-সম্পাদক বা আমি কতটা করতে পেরেছি তা প্রশ্বের দাবি রাখে। জয়-লেখকের দীর্ঘ সময়কালে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা ছিল। তাদের অবহেলা জনিত ব্যর্থতা ছিল অনেক ক্ষেত্রে। ভুল ভ্রান্তি শুধরে আগামীতে সুন্দর নেতৃত্ব আসবে এই প্রত্যাশা।

আরেক সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, যে কোনো কাজে সফলতা ব্যর্থতা থাকবেই। ওনাদের ক্ষেত্রেও কিছুটা সমালোচনা মিডিয়ায় যেমন হয়েছে পার্টির অভ্যন্তরেও হয়েছে। এবং সমালোচনাকে ওনারা পজিটিভলি নিয়েছে, এটাই ওনাদের বড় কৃতিত্ব। আশা করছি সুন্দর একটা সম্মেলনের মাধ্যমে বর্তমান ছাত্রলীগ নতুনভাবে নতুন কাউকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার ফোন দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।



 

Show all comments
  • তুষার মিয়া ৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:৪০ এএম says : 0
    বহুত হইছে এবার ভাগেন
    Total Reply(0) Reply
  • শেখ আবু জুওয়াইরিয়া ৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:৪০ এএম says : 0
    তাদেরকেও জয় বাংলা কইরা দিলো! জয় বাংলা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছাত্রলীগ

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ