Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুনাফা নাকি মানবতা? মাস্কের টুইটার কেনার নেপথ্যে কোন ‘বিশেষ কারণ’?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০২২, ৫:২২ পিএম

টুইটারের মালিক হওয়ার পর থেকেই প্রশ্নগুলি ভাসছিল। ইলন মাস্ক কেন টুইটার কিনতে গেলেন? বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তির এ হেন সিদ্ধান্তের পিছনে আসল কারণ কী? হাতের কাছেই তো রয়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ বা পিন্টারেস্ট-এর মতো নেটমাধ্যম। যেগুলি টুইটারের থেকেও তুলনামূলক ভাবে বেশি মুনাফা করছে। তবে লোকসানের খাতায় নাম লেখানো টুইটারেই কেন আগ্রহ টেস্‌লা কর্ণধারের?

বছরভর টানাপড়েনের পর অক্টোবরের ২৭ তারিখে টুইটার অধিগ্রহণ করেছেন মাস্ক। তার আগে থেকেই অবশ্য এ নিয়ে মাসের পর মাস টুইটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে তার। এক সময় তো টুইটার কেনার পরিকল্পনাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। শেষমেশ যা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। অবশেষে ২৮ অক্টোবর ইলনের একটি ছোট্ট টুইটে স্বস্তি ফিরেছে সমাজমাধ্যমে। লিখেছিলেন, ‘পাখি মুক্ত’। বিশ্ব জেনেছে, টুইটারের মালিক এ বার থেকে মাস্ক! চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি টুইটার অধিগ্রহণের পরিকল্পনায় প্রথম পা ফেলেছিলেন মাস্ক। সেই মাস থেকে টুইটারের শেয়ার কেনা শুরু করেন। মার্চের মধ্যে মাস্কের হাতে আসে ‘মাইক্রোব্লগিং সাইট’টির ৫ শতাংশ শেয়ার। তার পর এপ্রিলে মাস্ক ঘোষণা করেন, ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার খরচ করে টুইটার কিনতে চান তিনি।

এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত টুইটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বার বার ঠোকাঠুকি লেগেছে মাস্কের। বরাবরই বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করা মাস্কের ইঙ্গিত ছিল, তিনি মালিক হলে টুইটারের খোলনলচে বদলে ফেলবেন। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে টুইটারের নিষেধাজ্ঞাকে তো মাস্ক খোলাখুলিই তকমা দিয়েছিলেন, ‘‘চূড়ান্ত বোকামির সিদ্ধান্ত!’’ মে মাসে টুইটার অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার ভাবতে বসেছিলেন মাস্ক। ‘মাইক্রোব্লগিং সাইট’ কর্ত়ৃপক্ষের কাছে দাবি করেন, আগে টুইটারে স্প্যাম এবং ভুয়ো অ্যাকাউন্টের তথ্য দিতে হবে। তা না হলে টুইটার কেনার পরিকল্পনা বাতিলের হুমকিও দেন তিনি। শেষমেশ মাস্কের বিরুদ্ধে আদালতে যান টুইটার কর্তৃপক্ষ।

অক্টোবরের গোড়ায় ডেলাঅয়্যারের আদালত মাস্ককে নির্দেশ দিয়েছিল, চলতি মাসের ২৮ তারিখের মধ্যেই টুইটারের অধিগ্রহণের বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। দু’পক্ষই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত না নিলে নভেম্বরে এই মামলার শুনানি শুরু হত। তাতে নাকি মাস্কের হার অনিবার্য ছিল। তবে কি আদালতের চাপে পড়েই টুইটার কিনলেন মাস্ক? এমন প্রশ্নও উঠছে। ২৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে ইলনের টুইটার হ্যান্ডলে ভেসে উঠেছিল বেসিন (সিঙ্ক) হাতে তার একটি ভিডিও। টুইটারের সদর দফতরে তা রাখার জায়গা খুঁজছেন ধনকুবের মাস্ক। সঙ্গে তার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘টুইটারের সদর দফতরে ঢুকছি— লেট দ্যাট সিঙ্ক ইন!’’ যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, চুক্তি সফল! টুইটার তার।

টুইটার যে সত্যিই তাঁর পকেটস্থ, তা জানান দেন আরও একটি টুইটে। ২৮ অক্টোবর মাস্ক লিখছিলেন, ‘‘দ্য বার্ড ইজ় ফ্রিড।’’ টুইট-পাখি মুক্ত! মাস্কের দাবি অনুযায়ী, যে বাক্‌স্বাধীনতার উপরে শিকল পরানো থাকে টুইটারে, সেই শিকলই কি এ বার ভাঙতে চান তিনি? সে প্রশ্নও উঠেছে। যদিও নিন্দকদের খোঁচা— আসলে টুইট-পাখিকে ধ্বংস করতে চান তিনি। টুইটারের সর্বেসর্বা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মাস্ক। এক ঝটকায় ছাঁটাই করেছেন টুইটারের সিইও পরাগ আগরওয়াল, লিগাল এগজ়িকিউটিভ বিজয়া গাড্ডে, চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার নেড সিগাল এবং জেনারেল কাউন্সেল শিন এজ়েটকে।

টুইটার অধিগ্রহণের পর ৪ কর্তাকে সরানোর জন্য নাকি আবার কোটি কোটি টাকা খসেছে মাস্কের। পরাগ, বিজয়া এবং নেডের পিছনে ১২ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। তাদের জন্য ইলন মাস্কের প্রায় ২০ কোটি ডলার খসে গিয়েছে বলেও অনেকের দাবি। আসলে ওই শীর্ষকর্তাদের চাকরির মেয়াদ শেষের আগেই সরিয়ে দেয়ায় তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই বিপুল অর্থ দিতে হয়েছে মাস্ককে। টুইটারের পিছনে পানির মতো এত কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন কেন মাস্ক? অধিগ্রহণের আগের দিন টুইটারের বিজ্ঞাপনদাতাদের উদ্দেশে একটি বিবৃতিতে একাধিক কারণ জানিয়েছেন তিনি। তবে সে সবই কি কেবল মাস্কের কথার কথা? সন্দিহান অনেকে।

২৭ অক্টোবরের ওই টুইটে মাস্কের দাবি, ‘‘আমি কেন টুইটার অধিগ্রহণ করলাম, তা ব্যক্তিগত ভাবে সকলকে জানাতে চাই। কারণ, মানবতার ভবিষ্যতের খাতিরে সমস্ত পক্ষের স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য একটা ডিজ়িটাল মঞ্চ থাকা উচিত। যেখানে সুস্থ পরিবেশে কোনও রকমের গা-জোয়ারি ছাড়াই বিভিন্ন বিষয়ের মতামতের বিতর্ক হতে পারে।” এই মুহূর্তে নেটমাধ্যম যে কট্টর বাম এবং দক্ষিণপন্থীদের প্রকোষ্ঠে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার বিপদসঙ্কুল পথে দাঁড়িয়ে, তা মনে করেন মাস্ক। এবং এর জেরে সমাজে বিদ্বেষ বাড়তে পারে। সমাজে বিভাজন গড়ে উঠতে পারে। ওই টুইটে সে আশঙ্কাও করেছেন মাস্ক।

অবিশ্বাসীরা অবশ্য মাস্কের এই দাবির পরেও প্রশ্ন তুলতে কসুর করেননি। টুইটারের লোকসানের খতিয়ানও তুলে ধরেছেন তাঁরা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত টুইটারের নিট মূল্য ৪,০৮৩ কোটি ডলার। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এটি মুনাফা করেছে ১২০ কোটি ডলার। তবে গত বছরের এই সময়ের থেকে তা ১ শতাংশ কম। এমনকি, মুনাফায় মেটা-র থেকে তা ২৫ গুণ কম। লোকসানের নিরিখে ২৭ কোটি ডলার পানিতে গিয়েছে টুইটারের। লাভ-লোকসান ছাড়াও ব্যবহারকারীদের নিজের দিকে টেনে আনার ক্ষেত্রেও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম-সহ বহু সমাজমাধ্যমের থেকে পিছিয়ে টুইটার। চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দৈনিক ২৩.৮ কোটি ইউজ়ার বা ব্যবহারকারী রয়েছে এর। অথচ ফেসবুকের দাবি, তাদের সাইটে দৈনিক ১৯৮ কোটি লোকজনের যাতায়াত।

হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম মিলিয়ে মেটা-র ক্ষেত্রে তা দৈনিক ৩০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। পিন্টারেস্ট, স্ন্যাপচ্যাট বা টিকটকও নাকি মুনাফায় টুইটারের থেকে বহু যোজন এগিয়ে রয়েছে। মাস্কের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘গবেষণা’ করতে বসে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সাইটগুলি আমজনতার মধ্যে জনপ্রিয় হলেও টুইটার ক’জন ব্যবহার করেন? তা তো রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং খ্যাতনামীদের মতো সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্গের মধ্যে জনপ্রিয়। আমজনতার মনপসন্দ কি হয়ে উঠতে পেরেছে টুইটার? তবে এ সংস্থা কেনার আসল কারণ কী? এ কি ৫১ বছরের মাস্কের খামখেয়ালিপনা?

যে যা-ই বলুক না কেন! টুইটার যে সোনা ফলাবে, তা মনে করেন খোদ মাস্ক। বিশ্বের ধনীতমের দাবি, তিনি বিশ্বাস করেন, যত কোটি ডলার খরচ করে টুইটার কিনেছেন, তার থেকে দশ গুণ বেশি মূল্য এটির। সে জন্যই কি ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মধ্যে নিজের সম্পত্তি থেকে ১,৫০০ কোটি ডলার ঢেলেছেন তিনি? টুইটার কিনতে বাকি অর্থ এসেছে ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড এবং অন্যান্য লার্জ ফান্ড থেকে। এই অধিগ্রহণে ১০০ কোটি ডলার ঢেলেছেন ওর‌্যাকল্‌-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসনও। এ ছাড়া, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে বাকি ১,৩০০ কোটি ডলার তোলা হয়েছে।

‘ছোট্ট’ টুইট-পাখিকে নিয়ে কোন স্বপ্ন বুনছেন মাস্ক? তার কাছে তো টেস্‌লা-র মতো গাড়ি প্রস্ততকারী সংস্থা রয়েছে। স্পেসএক্স-এর মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থাও গড়ে তুলেছেন। আর্থিক মূল্যের বিচারে টুইটারের থেকে যেগুলি বহু গুণ ওজনদার। টেস্‌লার নিট মূল্য ৭০ হাজার ২৩৩ কোটি ডলার। অন্য দিকে, ১২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের নিট মূল্যের স্পেসএক্স নাসা-র মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকে টক্কর দিতে পারে। অনেকের দাবি, নিজের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করে টুইটারের ঘরে লাভের গুড় তুলতে চান মাস্ক। এই অধিগ্রহণের আগে থেকেই টুইটারে তার অনুরাগীর সংখ্যা ১১.১৪ কোটি। অনুরাগীদের সংখ্যার বিচারে এই সাইটে তার থেকে এগিয়ে রয়েছেন একমাত্র বারাক ওবামাই। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ফলোয়ার ১৩.৩৪ কোটি। নিজের এই বিপুল সংখ্যক অনুরাগীদের কি টুইটারে টেনে আনতে পারবেন মাস্ক? বাস্তবে তা ঘটলে টুইটারের ব্যবসা যে তুঙ্গে উঠবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সূত্র: টাইমস নাউ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ