বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সূরাতুল আহযাবের ২১নং আয়াতে আল্লাহপাক মুমিনদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) মাঝে রয়েছে উত্তম অনুসরণ’। অর্থাৎ তিনিই উম্মাহর আদর্শ, তাঁর অনুসরণই কাম্য। ‘তোমাদের জন্য’ মানে তোমরা যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করো, আখেরাতের নাজাত প্রত্যাশা করো, যারা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো তাদের জন্য। এই আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে যে, রাসূলে কারীম (সা.)-এর অনুসরণ, তাঁকে উসওয়া হিসেবে গ্রহণ করা ঈমানের প্রধান দাবি। এই দাবি পূরণের জন্য আমাদের নবী-আদর্শ সঠিকভাবে জানতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে। যেন আমরা হতে পারি তাঁর প্রকৃত অনুসারী এবং আদায় করতে পারি তাঁর উম্মত হওয়ার হক।
রাসূলে কারীম (সা.) জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের আদর্শ। ইবাদত-বন্দেগি, আকীদা-বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার, আদব-আখলাক, স্বভাব-চরিত্র- সকল বিষয়ে আদর্শ। আর তা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। কাজেই তাঁর আদর্শের অনুসরণে নিজের কর্ম ও জীবনকে গড়ে তোলা আল্লাহর আদেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) হচ্ছেন পবিত্র ও নির্মল জীবনের নমুনা, কাজেই জীবনের যে ক্ষেত্রেই তাঁকে অনুসরণ করা হবে, জীবনের ওই ক্ষেত্রটি পবিত্র ও নির্মল হয়ে উঠবে। জীবনের অনেক অধ্যায়, অনেক অঙ্গন। এক বড় অধ্যায় স্বভাব-চরিত্র। কেউ যদি জীবনের এই অধ্যায়টিকে জ্যোতির্ময় করতে চায় তার কর্তব্য আল্লাহর রাসূল (সা.) এর অনুসরণ করা।
আল্লাহপাক তাঁর সম্পর্কে এই সনদ দিয়েছেন : ‘নিঃসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী, মহান আখলাকের অধিকারী।’ সুতরাং স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার উসওয়ায়ে রাসূলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজকের লেখায় আমরা শুধু একটি বিষয় নিয়ে একটুখানি আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আর তা হচ্ছে, আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সত্যবাদিতা। তিনি কেমন সত্যবাদী ছিলেন, সত্যবাদিতার শিক্ষা কত তাকিদের সাথে দিয়েছেন, শুধু শিক্ষাই নয়, সত্যবাদিতার গুণে গুণান্বিত করবার জন্য তাঁর সাহাবীগণকে কীভাবে তারবিয়াত করেছেন, সুন্নাহ ও সীরাতের কিতাবে তা বিস্তারিতভাবে আছে।
তাঁর জীবনের, স্বভাবের এক উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সত্যবাদিতা। নবুওতের আগ থেকেই তিনি তাঁর সমাজে প্রসিদ্ধ ছিলেন সত্যবাদী ও আমানতদার হিসেবে। আমরা সবাই এই বিষয়টি জানি। এই প্রসিদ্ধি কি একদিনে হয়েছিল? না, একদিনে হয়নি। ভাবমর্যাদা একদিনে গড়ে ওঠে না। তা গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, নানা ঘটনায়, নানা পরিস্থিতিতে।
আরবের কুরাইশের মাঝে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর কথা-কাজ, তাঁর আচার-আচরণ সব তাদের সামনে ছিল। তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন তাদের সামনে ছিল। এই দীর্ঘ জীবনে তাঁর কর্ম ও আচরণ থেকে তাঁর সমাজ এই বিশ্বাস গ্রহণ করেছে যে, এই মানুষটি একজন সত্যবাদী, আমানতদার মানুষ। নবুওতের পূর্বের ঘটনাবলীও আলোচনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন ঘটনা আপনাদেরও অনেকের জানা আছে।
সহীহ বুখারীতে এক অসাধারণ ঘটনা আছে। আল্লাহর রাসূল (সা.) এর উপর যখন প্রথম ওহী নাযিল হলো এবং তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন ওই সময় উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা (রা.) যে কথাগুলো বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, তা তাঁর উন্নত কর্ম ও চরিত্রের এক অসাধারণ সনদ। আম্মাজানের কথাগুলো সহীহ সনদে, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রা.-এর কাছে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছিলেন : আমি আজ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, এতে আমার প্রাণের আশঙ্কা হচ্ছে। উম্মুল মুমিনীন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন : না, এ হতেই পারে না। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন! আল্লাহপাক কখনো আপনাকে অপদস্থ করবেন না, (আল্লাহ পাক তো আপনাকে সম্মানিত করবেন,) কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন, অন্যের ভার বহন করেন, মেহমানদারী করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ান- (এইসকল গুণের অধিকারী যিনি, তাকে আল্লাহ পাক সম্মানিত করবেন, তাকে তিনি কখনো অপদস্থ করবেন না।) (সহীহ বুখারী : ৬৯৮২)। এখানে হযরত খাদীজা রাযিআল্লাহু আনহা, যিনি এই মানুষটির সাথে ইতিমধ্যে পনের বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন, তাঁর সনদ : আপনি সত্য কথা বলেন।’
আরেকটি দৃষ্টান্ত : দাওয়াতের প্রথম দিকের ওই ঘটনা তো আমাদের সবারই জানা আছে। সাফা পাহাড়ের ঘটনা। সহীহ বুখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, (কুরআন মাজীদে নিকটাত্মীয়দের দাওয়াতের আদেশ নাযিল হওয়ার পর) নবী (সা.) সাফা পাহাড়ে উঠলেন এবং উচ্চস্বরে বললেন, ‘ইয়া সাবাহাহ্!’ অর্থাৎ বিপদ! বিপদ! কুরাইশের লোকেরা পাহাড়ের সামনে উপস্থিত হলো।
তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন : আমি যদি তোমাদের বলি যে, একটি শত্রুদল এই পাহাড়ের ওপার থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করবে তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? সকলে বলল : আমরা আপনাকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখিনি। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন আযাবের আগের সতর্ককারী। (সহীহ বুখারী : ৪৯৭১)। এই ঘটনায় অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। তবে এখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হচ্ছে নবী (সা.) সম্পর্কে তার জাতির সাক্ষ্য : আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।