Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্ববিদ্যালয় চলে ছাত্রলীগের ইচ্ছামতো

ঢাবি ভিসিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের স্মারকলিপি ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনটির সন্ত্রাস বন্ধ, প্রক্টরের অপসারণ দাবি : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৮ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থাই এখন আর নেই। সেখানে নামে মাত্র ভিসি, প্রভোস্ট, প্রক্টর আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিচালনার মূল দায়িত্বে আছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের ইচ্ছে মতন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো, সেখানে ছাত্রের নামে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করা হচ্ছে এবং যখন প্রয়োজন তখন এই সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের দমন করা হচ্ছে। কিছু কিছু হলের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা হয় এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন অথবা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছেন। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস বন্ধ, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ প্রক্টরকে অপসারণ, হামলায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত এবং হলগুলোকে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামানের কাছে শিক্ষকদের সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে ক্যাম্পাসে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের ধারবাহিক হামলা মামলা এবং তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সংগঠনের পক্ষে এই স্মারকলিপি দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর গীতিআরা নাসরিন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর তানজিম উদ্দিন খান, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা এবং অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকটি সহিংস ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ উদ্বিগ্ন। ক্যাম্পাসে গত ছয় মাসে তিনটি বড় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা গেছে বিরোধী মতের ছাত্রসংগঠনগুলোকে লাঠিসোটা, লোহার পাইপ, রড জাতীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নির্বিচারে এবং নির্মমভাবে পিটিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মীরা।
ঘটনাগুলোর উল্লেখ করে বলা হয়, এই বছরের মে মাসে ছাত্রদলের এক সমাবেশে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের দুই দফায় পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেওয়া হয়। এই ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দোষী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেয়নি উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা এক মামলায় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। মে মাসের ওই ঘটনার পর ছাত্রদলকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হয়। এরপর ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটির নেতারা ২৭ সেপ্টেম্বর ভিসির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে ফুল ও মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে আসেন। ভিসির কার্যালয়ে যাওয়ার পথে নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। যথারীতি এই ঘটনাতেও এখনো পর্যন্ত দায়ী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এরপর, মাত্র কয়েকদিন আগে, ৭ অক্টোবর বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে ছাত্র অধিকার পরিষদ আয়োজিত স্মরণসভায় নির্মম হামলা চালায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। আহত ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের মারধর করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ এরপর অবিশ্বাস্যভাবে ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রায় ২০ জন নেতা-কর্মীকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আর ছাত্রলীগই আবার ছাত্র অধিকার পরিষদের ২৫ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে। মাত্র কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ নিপীড়নমূলক ঘটনার বিচার বা দোষীদের শাস্তি দেবার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ এখনো নজরে আসেনি।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, উল্লিখিত সংঘাতমূলক ঘটনার নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের যেই ব্যক্তিটির সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখার কথা সেই ব্যক্তিটি হলেন প্রক্টর এবং তার টিম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই প্রক্টরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকেই দেখা গেছে যে ছাত্রলীগ সংঘটিত নিপীড়ন আর নির্মম অত্যাচারের সব ঘটনাতেই নিপীড়নকারী ছাত্র নামধারী গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ তিনি কখনো নেননি। উল্টো নির্যাতিত শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন ধরনের হয়রানিতে ছাত্রলীগের সহযোগী হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। গত কয়েকমাসের ঘটনাতেও আমরা এর কোনো ব্যতিক্রম দেখিনি।
শুধু প্রক্টর নন, বর্তমানের সব ঘটনা পরম্পরা দেখে মনে হচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই এখন আর নেই। এখানে নামে মাত্র আছেন ভিসি, প্রভোস্ট, প্রক্টর। মূল দায়িত্বে আছে ছাত্রলীগ।
শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত অগাস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থীকে তার মেসেঞ্জার গ্রুপে দেওয়া এক মেসেজকে কেন্দ্র করে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেন জিয়া হলের প্রভোস্ট। পরে পুলিশ তদন্ত করে কোনো অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন ছাত্রের সবচেয়ে বড় অভিভাবক। সেই অভিভাবক একজন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাসে কি বিন্দুমাত্র নিরাপদ বোধ করবে?
স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন, গত কয়েকমাসের এইসব ঘটনা প্রবাহ পুরো দেশের সামগ্রিক রাজনীতি থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেও মনে হচ্ছে না। পুরো দেশ জুড়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির উপর যেরকম নির্বিচারে আক্রমণ চালানো হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। সেইক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই ক্যাম্পাসে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের উপর এই নিপীড়ন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জ্বার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা আপনাদের মতন শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত মানহানিকর।
শিক্ষক নেটওয়ার্কের ৪ দাবি: ভিসির কাছে দেয়া স্মারকলিপিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ৪টি দাবি জানায়। এর মধ্যে- হামলার ঘটনাগুলোর পূর্ণ এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িত ছাত্রদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতে এই ধরনের সহিংস ঘটনা যাতে আর সংঘটিত না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। প্রক্টোরিয়াল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ শিক্ষক গোলাম রাব্বানীকে অবিলম্বে অপসারণ করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একজন নিরপেক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া। হলগুলোকে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের দখল মুক্ত করে শিক্ষকদের দায়িত্বে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গ্রহণ।
এসব দাবির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এক সপ্তাহের সময় দেয়া হয়েছে। এরপর প্রশাসনের উদ্যোগ পর্যালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে কর্মসূচির পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, একটা সময় ছিল যখন ক্যাম্পাসটা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের দখলে ছিল ক্যাম্পাস। কিন্তু বিগত ১৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সেশনজট নেই, কোনো সন্ত্রাস নেই- এটা ছাত্রলীগেরই অর্জন। অন্যদিকে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে একটা কিলিং মিশন বাস্তবায়নের জন্য আসে। এটা সম্পূর্ণ বিএনপির স্পন্সরজনিত সন্ত্রাস। তাই আমরা মনে করি, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছাত্রলীগ

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ