Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছাতক সুরমা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায়

ছাতক (সুনামগঞ্জ) থেকে প্রতিনিধি | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০২২, ৪:২৭ পিএম | আপডেট : ৪:৩৫ পিএম, ১৫ অক্টোবর, ২০২২

সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকে সুরমা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে সেতু। বহুদিনের কাঙ্খিত স্বপ্ন এখন বাস্তাবায়িত হয়েছে। সেতুটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এটি উদ্বোধন হলে ছাতক উপজেলার দুইটিসহ দোয়ারাবাজার উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৪ লাখ মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দ্বার খুলবে। ওই অঞ্চলের মানুষ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। এলাকার চাষাবাদকৃত সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত পৌঁছে যাবে। এতে অর্থনৈতিক ভাবে এলাকার কৃষকরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। সেতু উদ্বোধন হলে মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তের দোয়ারাবাজারের বাংলাবাজার ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বাঁশতলা (হকনগর) সহ দর্শনিয় স্থানে পর্যটকরা সড়ক পথে সরাসরি দ্রুত ঘুরে আসা সম্ভব হবে। বাঁশতলা এলাকায় এবং আশপাশে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের সমাধিত করা হয় বাঁশতলার এ নির্জনে। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে নির্মাণ করা হয় বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ। এ স্মৃতিসৌধে যাওয়ার আগে চেলার খালের ওপর রয়েছে স্লুইসগেট। সীমান্ত ঘেষে আছে টিলার ওপর ঝুমগাঁও গ্রাম। এ গ্রামে বাস করে আসছেন গারো সম্প্রদায়ের মানুষ। এগুলো ছাড়াও রয়েছে নরসিংপুর ইউনিয়নের সোনালী চেলা নদী। যা ওই নদী পথে ভারতের পাহাড় ঘেষে পানির সাথে বালি ও পাথর আসে। বোগলা ইউনিয়নের বাগানবাড়ির পাশে করা হয়েছে বর্ডারহাট। এ হাটে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্রেতা-বিক্রেতারা আসেন। দুই দেশের নাগরিকের মিলন মেলায় পরিনত হয়। বোগলা ইউনিয়নের বালুচর চিলাইপাড় ও সুরমা ইউনিয়নের খাইমারা নদীতে পৃথক দুইটি রাবার ড্রাম রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড আছে সুরমা ইউনিয়নে। এটির চারপাশে এখনও গ্যাসের চাঁপে প্রতিনিয়ত ভূদভূদ হচ্ছে। যদিও এটি দোয়ারাবাজার উপজেলায় অবস্থিত তার পরও প্রায় ৩ যুগ ধরে আজও ছাতক গ্যাস ফিল্ড নামে রয়েই গেছে। চলতি বছরের গত মে মাসে সেতুর কাজ শেষ হয়। জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে এটির উদ্বোধনের পর জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে সুরমা সেতুর সংযোগ সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সেতুর এক পাশে সংযোগ সড়ক ভেঙে পরিনত হয়েছে বিশাল খালে। এ কারনে পিছিয়ে গেছে সেতুর উদ্বোধনের কার্যক্রম। বর্তমানে ভাঙা-গড়ার কার্যক্রম চলছে।

জানা যায়, ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট সুরমা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তখন ছিল বিএনপি সরকার। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন সেতুর স্বপ্ন দেখে দুই উপজেলার মানুষ। ৩ বছরের মধ্যে সেতুর কাজ সম্পন্ন করার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। কাজ শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর ৪টি স্তম্ভ (পিলার) নির্মাণ করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্মানাধীন সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অজ্ঞাত কারনে প্রকল্পটি এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) থেকে বাতিল করে দেয়া হয়। ২০১০ সালে সেতুটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ৫১ কোটি টাকার একটি নতুন সংশোধিত প্রকল্প যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। ওই আবেদনের পর আবার নতুন করে সেতু নির্মানে ২০২০ সালে ১১৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সওজের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেকে) ১১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরমা সেতুর পুনঃনির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর নেভিগেশন, এ্যাপ্রোচ, ভূমি অধিগ্রহণসহ কয়েক দফায় প্রকল্প অনুমোদন করে মোট ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মিত হয়।

স্থানীয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্রে জানা যায়, সুরমা সেতুর মূল নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ক'মাস আগে। সেতুর উভয় পাড়ে ২.৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ্যাপ্রোচ (সংযোগ) সড়ক ও টোলপ্লাজা নির্মাণ কাজের প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। সংযোগ সড়কের মধ্যে ছাতক থেকে মাধবপুর অংশে ১.৬০ কিলোমিটার এবং দোয়ারবাজার সড়কের সাথে সংযোগ ৮শ’মিটার নতুন সড়ক ও রাস্তা নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করার জন্য ঠিকাদারকে তাগিদ দিয়েছে সওজ কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুরমা সেতুর নির্মান কাজ শেষ হলেও সেতুর উভয় পাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যায় পড়ে স্থানীয় সওজ বিভাগ। পরবর্তীতে স্থানীয় এমপি মুহিবুর রহমান মানিক ভূমি মালিকদের সাথে বৈঠক করে উচ্চ আদালতের মামলা উত্তোলনের (নো অবজেকশন) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সওজের একটি সূত্র জানায়, ১৭টি মামলার মধ্যে এখানের আকিজ কোম্পানীর মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া সুরমা সেতুর উত্তর পাড়ের বারকাপন ও দক্ষিণ পাড়ের বাঁশখলা গ্রামের দু’টি পরিবারের সাথে জটিলতা থাকলেও এগুলো সমাধানের শেষ পর্যায়ে।

স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দোয়ারাবাজার উপজেলার ৯টির মধ্যে ৬টি ইউনিয়ন রয়েছে সুরমা সেতুর উত্তর পাড়ে। ইউনিয়নগুলো হলো, বাংলাবাজার, নরসিংপুর, দোয়ারাবাজার সদর, বোগলা, লক্ষিপুর ও সুরমা। এর মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেষে। এসব ইউনিয়নের প্রতিটি রাস্তা-ঘাটের যোগাযোগ অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ কালভার্টের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা-পাকা অনেক রাস্তা পানির প্রবল স্রোতে ভেঙে দূর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। নির্মিত সেতুর সংযোগ রাস্তাগুলো প্রশস্থসহ সংস্কার করা না হলে যোগাযোগ ক্ষেত্রে ওই এলাকাবাসীর দূর্ভোগ রয়েই যাবে। ছাতক উপজেলার ১৩টির মধ্যে উত্তর পাড়ে রয়েছে নোয়ারাই ও ইসলামপুর নামের ২টি ইউনিয়ন এবং ছাতক পৌরসভার একটি অংশ। এর মধ্যে নোয়ারাই ও ইসলামপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ কালভার্টের অবস্থা বেহাল।

দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রেনু মিয়া বলেন, সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে দোয়ারাবাজারের ৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। এগুলোর প্রতিটি পাকা-কাঁচা সড়কের অবস্থা বেশ নাজুক। ভয়াবহ বন্যায় আরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এ কারণে এ অঞ্চলের মানুষের দূর্ভোগের শেষ নেই। তিনি বলেন, সুরমা নদীর ওপর সেতু উদ্বোধন হলে দোয়ারার এ ৬টিসহ ছাতকের নোয়ারাই এবং ইসলামপুর ইউনিয়ন ও পৌরসভার অংশে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হবে, যদি সেতু সংযোগ রাস্তার সাথে প্রতিটি এলাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করা হয়।

দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী (বীরপ্রতীক) বলেন, সুরমা সেতুর দোয়ারাবাজার সদরের সড়কের সংযোগের পাশাপাশি পূর্বদিকে নোয়ারাই হয়ে বালিউরা পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে বাংলাবাজার, নরসিংপুর, নোয়ারাই ও ইসলামপুর এই ৪টি ইউনিয়নের মানুষ যোগাযোগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত রয়ে যাবে।

ছাতক সড়ক উপ-বিভাগের (সওজ) উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাসুম আহমদ সিদ্দিকী বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ সেতু সংযোগ সড়ক মেরামতের জন্য দ্রুত কাজ চলছে। সেতুর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কের ভাঙা স্থানে ৫টি ভাগে ১০৮টি পানি নিস্কাশনের জন্য রিং বসানো হচ্ছে। পরবর্তীতে এখানে স্থায়ী ভাবে কালভার্ট নির্মাণ হবে। সেতুর আশপাশে ভুমি মালিকদের সাথে কিছু জটিলতা রয়েছে, এ গুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।

সুনামগঞ্জ-৫, ছাতক-দোয়ারাবাজার আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, এ সেতু চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এছাড়া, উত্তর সুরমার প্রায় ৪ লাখ মানুষ এর যোগাযোগের দুর্ভোগ ঘুচবে। তিনি বলেন, স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যায় অন্যান্য রাস্তার ন্যায় এই নির্মানাধীন সেতুর সংযোগ সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন এটির সংস্কার কাজ চলছে। কাজ সমাপ্ত হলেই আর কোনো জটিলতা নেই। সেতু থেকে বালিউরা হয়ে বাঁশতলা -হকনগর পর্যন্ত রাস্তাটি প্রশস্থ করণ করা হবে। এতে বাঁশতলা হকনগর পর্যটন কেন্দ্রে যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধিসহ ওই এলাকায় চাষাবাদকৃত সবজি দ্রুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এলাকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। তিনি আরও বলেন, ইসলামপুর ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাথেও সেতু পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বৃত্তের মতো উত্তর ছাতক ও দোয়ারাবাজার অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই এলাকা অনেকটা এগিয়ে যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উদ্বোধনের অপেক্ষায়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ