বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
নবী (সা.) এর সীরাত বা জীবনীর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য-এর ঐতিহাসিকতা। অর্থাৎ শক্তিশালী বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত প্রামাণিক জীবনালেখ্য, যার প্রতিটি তথ্য বর্ণনা-বিচারের নিখুঁত মানদণ্ডে পরীক্ষিত। আমরা যদি অন্যান্য ধর্ম-পুরুষদের এই মানদণ্ডে বিচার করি, তাহলে দেখা যাবে কারো জীবন-চরিত এই মানদণ্ডে পূর্ণ উত্তীর্ণ নয়।
আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে প্রেরিত অধিকাংশ নবীদের সম্পর্কেও এখন বেশি কিছু জানা যায় না। তাওরাতে হযরত মূসা আ.-এর জীবন সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে তবে বিদ্যমান ‘তাওরাতে’র শুদ্ধতা ও প্রামাণিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। একই কথা কথিত ‘ইঞ্জিল’ সম্পর্কেও। সবাই জানেন, খ্রিস্টজগত অগণিত ইঞ্জিলের মধ্য হতে শুধু চারটিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করে। ঐ চার ইঞ্জিলেও রয়েছে প্রচুর বৈপরীত্য। আর এগুলোর লেখকদের কেউই হযরত ঈসা (আ.)-কে স্বচক্ষে দেখেনি এবং এগুলোর রচনার সন-তারিখ সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
বিপরীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনেতিহাস দেখুন। মুসলমানগণ তাদের নবীর জীবনী এবং তাঁর সাথে সামান্য সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তির জীবনীও এত পরিশ্রম ও গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ করেছে যে, ইতিহাসে এর নজির পাওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন তাঁর সকল বাণী ও কর্ম অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার আদেশ করেছেন, তেমনি এ বলে হুঁশিয়ারও করেছেন যে, কেউ যদি আমার সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল কথা অথবা মিথ্যা কথা বর্ণনা করে, তাহলে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এই হুঁশিয়ারির কারণে বড় বড় সাহাবীও তাঁর সম্পর্কে কোনো কিছু বর্ণনা করার সময় ভীত ও সতর্ক থাকতেন। আর এ কারণেই আজ তাঁর জীবনী শুধু সংরক্ষিতই নয়, অবিকৃত ও অপরিবর্তিতরূপে সংরক্ষিত রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র জীবনীর সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস হলো, কোরআনে কারীম, যার প্রামাণিকতা ইসলামের শত্রুদের পক্ষেও অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। কোরআন মাজীদে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল অংশ পাওয়া যায়। তাঁর নবুওতের পূর্বের জীবন, তাঁর দারিদ্র্য ও এতিম হওয়া, ওহী ও নবুওত, মিরাজ ও দ্বীন প্রচার, হিজরত ও জিহাদ এবং তাঁর চরিত্র ও গুণাবলী ইত্যাদি। এর চেয়ে শক্তিশালী ও প্রামাণিক গ্রন্থ পৃথিবীতে নেই।
সীরাতের দ্বিতীয় উৎস, হাদীস-গ্রন্থসমূহ, যাতে একেকটি তথ্য পূর্ণ সনদ ও সূত্র সহকারে সংরক্ষিত। এরপর আছে ‘মাগাযী’ ও ‘সীরাত’ শীর্ষক গ্রন্থাবলী। আছে তারীখ ও ইতিহাসের কিতাবসমূহ। আছে ‘শামায়েল’-এর কিতাবসমূহ। শামায়েলের কিতাবসমূহে তাঁর চরিত্র, আচার-আচরণ, উত্তম গুণাবলী এবং দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজকর্ম আলাদাভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী অন্য কোনো নবী বা ধর্ম-গুরুর জীবনীর মত নয়; বরং তাঁর জীবনী ঐতিহাসিক বিচারেও পুরোপুরি সংরক্ষিত। এটি তাঁর সীরাত ও জীবনেতিহাসের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
কারো জীবন ও কর্ম অনুসরণীয় হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তা নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ হওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কারো জীবন ও কর্ম সম্পর্কে উপরোক্ত মূল্যায়ন তখনই সম্ভব যখন তার জীবনের সব দিক তার যুগের লোকদের সামনে থাকে আর তার মৃত্যুর পর তা ইতিহাসে সংরক্ষিত থাকে।
এই পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব অতিবাহিত হয়েছেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে তাদের কারো তুলনা চলে না। কারণ, জীবনের ছোট থেকে ছোট বিষয়েও তাঁর শিক্ষা রয়েছে। আর নিজেও তিনি ছিলেন উত্তম গুণাবলীর অধিকারী। মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্য সৃষ্টি করেছেন যে, কোথাও কোনো প্রান্তিকতা অবশিষ্ট থাকেনি।
তাঁর পবিত্র জীবনের সকল দিক শুধু তাঁর জামানার লোকদের সামনেই ছিল এমন নয় বরং তাঁর জীবনের সকল দিক ও ঘটনা ইতিহাসের পাতায়ও সংরক্ষিত আছে, যার সাহায্যে আজও তাঁর নিখুঁত ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া সম্ভব। দেখুন, সকল কীর্তিমান পুরুষ নিজ পরিবারে ও আপন স্ত্রীর কাছে একজন সাধারণ মানুষ। তার ভেতরের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে তার স্ত্রীই সবচেয়ে বেশি অবগত থাকে, অথচ আমরা দেখতে পাই যে নবুওতপ্রাপ্তির পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর নবুওতের কথা সর্বপ্রথম হযরত খাদিজা (রা.)-এর কাছেই বলেছিলেন, যিনি ছিলেন পনেরো বছর যাবৎ তাঁর জীবনসঙ্গিনী। তাঁর ভেতর বাহির সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। নবুওতপ্রাপ্তির সংবাদ শোনার পর তিনি শুধু তাঁর প্রতি ঈমানই আনেননি; বরং সাথে সাথে তাঁকে সর্বক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যান। এটা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিখুঁত ব্যক্তিত্বের এক বড় প্রমাণ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।