Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থক সম্পাদককে যেভাবে হত্যা করেছিল ব্রিটিশরা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১:৫৭ পিএম | আপডেট : ৭:৩১ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

১৮৫৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে ভারতে শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ। ভারতীয় ঐতিহাসিকরা বেশ কয়েক দশক ধরেই এটিকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে বর্ণনা করে আসছেন। বিট্রিশরা সেই বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করে। নির্বিচারে হত্যা করা হয় বিদ্রোহে সমর্থনকারী সাধারণ মানুষকে।

দিল্লির মসনদে তখনও ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। যদিও সে সময় সকল ক্ষমতাই চলে গিয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে। সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হতেই দিল্লির বাইরে বিরাট সংখ্যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনী জড়ো হতে শুরু করে। সে সময় ধীরে ধীরে বিদ্রোহী ভারতীয় সৈন্যদের প্রতিরোধ ভাঙতে শুরু করেছে ব্রিটিশ বাহিনী। আর একটু একটু করে দিল্লি পুনর্দখল করতে শুরু করেছে কোম্পানির সেনারা। এরকমই একটা সময়ে তাদের হাতে ধরা পরে গেলেন মৌলভী মুহম্মদ বাকার।

এখন যেখানে দিল্লির কাশ্মীরী গেট এলাকা, সেখানেই একটা ইমামবরা গড়েছিলেন শিয়া মুসলমান ধর্মপ্রচারক মৌলভী মুহম্মদ বাকার। তার বসবাসও ছিল ওই অঞ্চলেই। তবে শিয়া ধর্মপ্রচারকের থেকেও বড় আরেকটা পরিচয় ছিল এই মৌলভী বাকারের। তিনি ছিলেন দিল্লির একটি উর্দু সংবাদপত্রের সম্পাদক। পত্রিকার নাম ছিল ‘দিল্লি উর্দু আখবার’, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪১ সালে। সেটা ছিল দিল্লির প্রথম উর্দু পত্রিকা।

মৌলভী বাকারকে গ্রেপ্তারের পরে নিয়ে যাওয়া হল বাহিনীর কর্মকর্তা মেজর হডসনের কাছে। কোনও অভিযোগ দায়ের হল না, কোনও বিচার হল না, সরাসরি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে মেরে ফেলা হল। ১৮৫৭-র বিদ্রোহের গবেষক, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ জাহির হুসেইন জাফরি বলছেন, ‘মৌলভী বাকারকে ১৮ অথবা ১৯ সেপ্টেম্বর মেরে ফেলে ব্রিটিশ বাহিনী।’ তবে ইতিহাসবিদ রানা সাফভি লিখছেন, ‘মৌলভী বাকারকে আটক করা হয় ১৪ সেপ্টেম্বর, আর দুদিন পরে ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।’

আবার আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও জনসংযোগ বিভাগের চেয়ারম্যান সাফে কিদওয়াই ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন যে ঠিক কীভাবে মৌলভী বাকারকে ব্রিটিশরা হত্যা করেছিল তার কোনও লিখিত প্রমাণ নেই। তবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে মৌলভী বাকারকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখার ঝুঁকি নিতে চায় নি, সেটা পরিষ্কার গবেষকদের কাছে। সিপাহি বিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের আগের কয়েক মাসে মৌলভী বাকারের লেখাগুলো ছিল প্রচন্ড ব্রিটিশ বিরোধী। তার সংবাদপত্র, ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ বিদ্রোহী সিপাহীদের সমানে উদ্বুদ্ধ করে গেছে কোম্পানির বিরুদ্ধে!

অধ্যাপক জাফরি বলছেন, ‘বিদ্রোহ নিয়ে গোড়ার দিকে কিন্তু দিল্লি উর্দু আখবার একরকম নিঃস্পৃহই ছিল। কিন্তু চার সপ্তাহের মধ্যেই লেখার ধরন বদলিয়ে ফেলেন মৌলভী বাকার। বিদ্রোহী সিপাহীদের সম্পূর্ণ সমর্থন করতে শুরু করেন তার পত্রিকায়। তার লেখাগুলো ভীষণভাবে উদ্দীপনা জাগাত বিদ্রোহী সিপাহীদের মনে। এমন কি নিজের ছেলেকে দিয়ে কবিতাও লেখাতেন পত্রিকায়। সেই সব কবিতাও উদ্বুদ্ধ করত বিদ্রোহীদের।’ ‘তার ছেলে মুহম্মদ হুসেইন আজাদের লেখা একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। পবিত্র কুরানের একটা অংশ উল্লেখ করে আজাদ তার কবিতায় লিখেছিলেন যে ‘হে মানুষ, যাদের চোখ আছে, তারা দেখ, তার এই পতন দেখে শিক্ষা নাও।’ এখানে ব্রিটিশদের পতনের কথা বোঝানো হয়েছে,’ ব্যাখ্যা করছিলেন অধ্যাপক জাফরি।

শিয়া ধর্মপ্রচারক হয়েও বিদ্রোহের সময়ে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা যে খুব জরুরী সেটা উপলব্ধি করেছিলেন মৌলভী বাকার। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য কলম ধরেছিলেন তিনি। অধ্যাপক জাফরি বলছিলেন, ‘খৃষ্টান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দু - মুসলিম ঐক্য ধরে রাখতে তার কাগজে তিনি ক্রমাগত লিখে গেছেন। ব্রিটিশরা অনেকবার চেষ্টা করেছে হিন্দু - মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাতে। তারা মসজিদের দেওয়ালে কাউকে দিয়ে একটা পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছিল, যাতে লেখা ছিল ইসলাম আর খৃষ্ট ধর্ম - দুটিই সেমেটিক ধর্ম। তাই এই দুই ধর্মের মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।’

মৌলভী বাকার তার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ওই পোস্টারের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। ‘তিনি দেখিয়েছিলেন যে হিন্দু, জৈন, মুসলমান - এদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে খৃষ্টান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে,’ বলছিলেন অধ্যাপক জাফরি। তিনি আরও জানাচ্ছিলেন যে সেবছর ঈদ উল আজহার দিনে দিল্লিতে কোনও গরু কোরবানি করতে দেন নি বাদশাহ। কোরবানি বন্ধ করতে রীতিমতো পরোয়ানা জারি করেছিলেন তিনি।

অধ্যাপক জাফরির কথায়, ‘বাদশাহ মনে করেছিলেন গরু কোরবানি করা হলে তা নিয়েই হিন্দু সিপাহীদের সঙ্গে মুসলমানদের ঝামেলা লাগতে পারে। ব্রিটিশরা সেরকমই একটা সুযোগ খুঁজছিল। তাই পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আর অন্যদিকে মৌলভী বাকার এই প্রশ্নে কলম ধরেছিলেন। সেবছর দিল্লিতে কোনও গরু কোরবানি হয় নি।’ রানা সাফভিও বলছেন, ‘বিদ্রোহের সময়ে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য বজায় রাখার প্রচেষ্টাটাই সম্ভবত মৌলভী বাকারের সব থেকে বড় অবদান। আর ব্রিটিশরা এটা ঠিকই বুঝেছিল যে এই হিন্দু মুসলমান ঐক্য একটা কঠিন শিক্ষা দিয়ে গেল।’

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জর্জ উইলিয়াম ফরেস্ট বিদ্রোহের ঠিক পরেই যে ‘স্টেট পেপার্স’ প্রকাশ করেছিলেন, তার মুখবন্ধ উদ্ধৃত করে রাণা সাফভি বলছেন, ‘ভারতীয় বিদ্রোহ যে অনেকগুলি শিক্ষা দিয়ে গেল, তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হল ব্রাহ্মণ, শূদ্র, হিন্দু আর মোহামেডানরা যদি আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে একটা বিদ্রোহ করে ফেলতে পারে তারা।’ তাদের সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছেন যে সম্পাদক, বিদ্রোহীদের উৎসাহ উদ্দীপনা যুগিয়েছেন যিনি লাগাতার, সেই মৌলভীকে কি দিল্লি পুনর্দখলের পরে আর বাঁচিয়ে রাখে ব্রিটিশরা? সূত্র: বিবিসি।

 



 

Show all comments
  • MD Akkas ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৫:২৭ পিএম says : 0
    তার পর ও কি তোমারা (হিন্দুরা) বলতে চাও !ভারত বর্ষে্র স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমানদের অবদান নেই?
    Total Reply(0) Reply
  • #soumyakanti #chakraborty ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:৩১ এএম says : 0
    ভারতবর্ষ কোনোদিন অস্বীকার করেনি যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের কোনো অবদান নেই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্রিটিশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ