Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়ছে ইসির প্রতি আস্থাহীনতা

ইভিএমে ভোট গ্রহণে আগ্রহ আজ চূড়ান্ত হতে পারে নতুন ২ লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতি আগ্রহ জনমনে নানান সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। একই সাথে ইসির ঘোষিত রোডম্যাপে ইভিএম নিয়ে যে অসত্য তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে এ সংস্থাটির প্রতি রাজনৈতিক দলের আস্থাহীনতা আরও বেড়ে গেছে। সংলাপে অংশ নিয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে মত দিলেও ইসি তাদের ঘোষিত রোডম্যাপের পক্ষে মত দেয়া দলের সংখ্যা বেশি বলে দাবি করেছে। ইসির সঙ্গে জুলাই মাসে সংলাপে অংশ নিয়ে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছিল মাত্র চারটি দল। কিন্তু রোডম্যাপে ইসি ১৭টি দল ইভিএমের পক্ষে বলেছে এমন তথ্য দিয়েছে। এতে করে ইসির প্রতি রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা আরও বাড়ছে। ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে ইসির এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য দেখে রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্টজনরা বিস্ময় ও হতাশা ব্যক্ত করেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে ইভিএম ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সর্বমহলে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইসি প্রথমে ইভিএমের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সরকারি দল ইভিএমে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশন এ নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছাপূরণেই কাজ করছে। তাছাড়া ইভিএম নিয়ে একটা বড় বাণিজ্য আছে। হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। এজন্যও বেশি দলের মতকে পক্ষে দেখিয়ে ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদনের চেষ্টা হতে পারে। তবে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আস্থার সঙ্কট আরও বাড়বে।
ইভিএমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ইসি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন আজ এ নিয়ে বৈঠক করে প্রকল্পের মোট বাজেট নির্ধারণ করার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২ লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাব দেওয়া হবে। আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পেলেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত ১৫০ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। তবে সরকার চাইলে এর আগেও হতে পারে। তাই প্রকল্প দ্রুত পাস না হলে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রগণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আর থাকবে না নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটির হাতে।

প্রসঙ্গত, ইসির প্রথমবার দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একনেকে পাস হয়। প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়। এছাড়া ৭৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় আসবাবপত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার চুক্তি করা হয়। ওইসব মেশিন সংরক্ষণ নিয়ে এখন জটিলতায় পড়েছে ইসি সচিবালয়। চলতি মাসের শুরুতে ইসির এক কর্মশালায় বলা হয়, অব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ে থাকা ইভিএম ৩০ ভাগ এই মুহূর্তে অকেজো। অকেজো এসব ইভিএমের বেশিরভাগই হার্ডওয়্যার সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। এর অনেকগুলোর যন্ত্রাংশ হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেছে। মাঠ পর্যায়ে থাকা ৯৩ হাজার ৪১০ সেট ইভিএমের মধ্যে কন্ট্রোল ইউনিট রয়েছে ৮০ হাজার ১৭০টির। বাকি ১৩ হাজার ২৪০টি কন্ট্রোল ইউনিটের খোঁজ নেই। ৭ হাজার ৩২৭টি কন্ট্রোল ইউনিটের ব্যাটারির হদিস নেই। এ অবস্থায় আরো দুই লাখ ইভিএম কিনতে নতুন প্রকল্প নিচ্ছে ইসি। ইসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন কমিশন নতুন ইভিএম কেনার যে প্রকল্প নিচ্ছে সেখানে এসব মেশিন নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের জনবল নিয়োগ, সংরক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ারহাউজ নির্মাণ ও পরিবহনের জন্য উপযোগী গাড়ি কেনারও ব্যবস্থা থাকছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান শর্ত হলো নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা থাকা। বর্তমান কমিশনের প্রতি এই আস্থার সঙ্কট রয়েছে। এ ছাড়া ইভিএম নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের সরাসরি আপত্তি রয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলও ভোটারদের আস্থা না থাকলে ইভিএমে যত ভালো নির্বাচনই হোক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ইসিকে এ বিষয়টি ভাবতে হবে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকার ইভিএমে নির্বাচন করতে চায় বলেই ইসিও এখন চাচ্ছে। সরকারের ইচ্ছাপূরণ করাই এই ইসির কাজ। সরকারও ইসিকে খুশি করতে ইভিএম কেনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প উপহার দিচ্ছে। আমাদের দেশে তো প্রকল্প মানেই অবাধ লুটপাট। এর আগেও ইভিএম কেনায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এবারও কত শত কোটি টাকা লুটপাট হবে সেটাই দেখার বিষয়। ইভিএমে নির্বাচন করার ব্যাপারে ইসির এত আগ্রহের পিছনে এটাও একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি শুরু থেকেই অনাস্থার কথা জানিয়ে আসছে অনেক রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বলছে, এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে কাজ করছে। এজন্য ইভিএম ব্যবহারের মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোডম্যাপ ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিবও তাদের প্রতি রাজনৈতিকদল ও জনগণের যে আস্থার সঙ্কট রয়েছে তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসি অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন, আস্থাশীলতার ঘাটতিতে রয়েছে। তারপরও ইভিএম কেনা এবং তা দিয়ে ভোট করার ব্যাপারে ইসির এত আগ্রহ সর্বমহলে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

চলতি মাসের ৬ তারিখ এক বিবৃতিতে দেশের ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানান। তারা ইভিএম ব্যবহারে ইসির নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেও উল্লেখ করেন। বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইভিএম কিনতে বিপুল ব্যয় (প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা) কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখারও অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে উল্লেখ করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে। ওই বিবৃতিতে সাক্ষর করেছেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এম হাফিজউদ্দিন খান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, ড. তোফায়েল আহমেদ, অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ