পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ছবিটি দেখেছেন? দৈনিক ইনকিলাবসহ দেশ-বিদেশের অনেকগুলো পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। ছবিটি প্রথম প্রচার করে মালয়েশিয়ার আরভিশন টিভি। কাদায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিশুটির নাম তোতাইত তৌহিদ। মালয়েশিয়া প্রবাসী রোহিঙ্গা মুসলিম জাফর আলম-ছেনোয়ারা বেগমের সন্তান। নাফ নদের তীরে কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মিয়ানমারের মংডু থানার বড়গজিরবিল গ্রামের বাসিন্দা। নব্য স্বৈরাচার সুচির বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোববার রাতে একদল রোহিঙ্গার সঙ্গে বাংলাদেশে আসার পথে মাঝ নদে নৌকা ডুবে যায়। প্রাণ হারান কয়েকজন। পানিতে ডুবে মরে থাকা তোতাইত তৌহিদের লাশ নাফ নদের কাদায় আটকে যায়। ছবিটি কি আপনার হৃদয়কে নাড়া দেয় না? নাড়া দিচ্ছে না কেন মুসলিম বিশ্বকে? জাতিসংঘ ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র ভূমিকা নিয়েছে। ওআইসি’সহ মুসলিম বিশ্ব কি ঘুমিয়ে রয়েছে? মুসলমান সমাজে ‘মুসলিম ভ্রাতৃত্ব’ শব্দ প্রচলিত আছে। তারপরও রোহিঙ্গা মুসলিম শিশু তোতাইত তৌহিদের দৃশ্য দেখেও আপনি নীরব!
আয়নাল কুর্দির কথা মনে আছে? ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভূমধ্য সাগর উপকূলে নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর লাল শার্ট গায়ে উপুড় হয়ে পড়া থাকা সিরিয়ান আয়নাল। নিথর দেহের মর্মস্পর্শী আয়নালের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে কেঁদে ওঠে সমগ্র পৃথিবী। এরপর বোমাক্রান্ত শিশু ওমর দাকনিশ। সিরিয়ার এই শিশুর রক্তাক্ত ধুলোমাখা শরীরের ছবি প্রকাশিত হলে দ্বিতীয়বার ধাক্কা খায় বিশ্বমানবতা। জেগে ওঠে বিশ্ববিবেক। খোদ হোয়াইট হাউজের টনক নড়ে। আয়নাল কুর্দির ছবি পশ্চিমা ইহুদি, খ্রিষ্টান বিধর্মীদের বিবেকে নাড়া দেয়। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ইসলাম বিদ্বেষী উন্নত দেশগুলো নানা বিতর্ক করলেও সিরিয়ার নাগরিকদের অভিবাসী হিসেবে গ্রহণে বাধ্য হয়। সিরিয়ার আয়নালের ছবি বিধর্মীদের কাঁদায়; অথচ রোহিঙ্গা মুসলিম শিশু তোতাইত তৌহিদের ছবি মুসলমানদের হৃদয় স্পর্শ করে না! নাফ নদের কাদায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রোহিঙ্গা মুসলমান শিশুর যে ছবিটা প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে এখনও ওই অর্থে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। প্রথমত, ছবিটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচারিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, শিশুটির পরিচয় দেশহীন রোহিঙ্গা মুসলিম। ফলে এ নিয়ে হয়তো বিশ্ববিবেক জাগ্রত হবে না। হোয়াইট হাউজ থেকে কোনো বিবৃতি আসবে না। কিন্তু আপনি কেমন মুসলমান হে? আপনার বিবেক জাগছে না?
চলুন ঘুরে আসি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কর্মকা- থেকে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে একজন ইহুদি আক্রান্ত হলে বা বিপদে পড়লে ১০ জনকে খুন করে প্রতিশোধ নেয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। হোয়াইট হাউজ মানবাধিকার রক্ষায় সরব হয়ে উঠে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হায় হায় করে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে ক্ষমতাসীন দলের এক এমপির সঙ্গে মন্ত্রীর বিরোধে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় হাইকমিশনারকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের খোঁজ নেয়ার জন্য ছুটে যান ভারতীয় কর্মকর্তারা নাসিরনগর। উত্তাল হয়ে উঠে নাসিরগর। ঢাকায় মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পরও আমরা একই দৃশ্য দেখি। গত বছর ভারতের একটি প্রদেশে ৩ জন খ্রিষ্টান নৃশংসভাবে খুন হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর ভাটিক্যান সিটিতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধানরা বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেন। স্বয়ং পোপ প্রতিবাদ করেন। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় আক্রান্ত হওয়ার পর চীন-মিয়ানমারসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলো প্রতিবাদ করেন। রোহিঙ্গা মুসলিমরা গণহত্যা ও গণধর্ষণের শিকার। অথচ মুসলিম বিশ্বের ৫৭টি দেশ নিয়ে গঠিত ওআইসি নীরব। ঘুমিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো। আমরাও কার্যত নীরব। একমাত্র ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে। গতকাল তারা ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। অতঃপর দলটির আমীর হজরত মাওলানা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম ১৮ ডিসেম্বর মিয়ানমার অভিমুখে লংমার্চের কর্মসূচি দিয়েছে। দেশের অন্যান্য ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল, আলেম ওলামা, মাদ্রাসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা ঘুমিয়ে কেন? ঘুমিয়ে কেন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো? যারা ‘মুসলিম ভ্রাতৃত্ব’ শব্দটি মানেন তারা কী নীরব থাকতে পারেন?
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে একমাত্র মালয়েশিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে নব্য স্বৈরাচার সুচির সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। দেশটিতে প্রতিদিন রোহিঙ্গা নিধন বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করছে হাজারো মানুষ। ৪ ডিসেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ ও র্যালিতে যোগ দেন খোদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলে বলেন, এই নিষ্ঠুরতা গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। বিশ্বের দেশে দেশে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা বন্ধের প্রতিবাদ হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আর কোনো রাষ্ট্রের সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে মুখ খোলেননি। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নব্য স্বৈরাচার অং সান সু চির কাছে দর্শকরা প্রশ্ন করেন, ‘আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার খবর বের হচ্ছে, আপনার বক্তব্য কী?’ প্রশ্নটি হেসে উড়িয়ে দেন মসদনের কাছে বিবেকবন্ধক রাখা সু চি। সেই হাস্যরসের ছবি আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। শুধু তাই নয়, সু চি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সঠিক খবর আসছে না বলেও উল্টো অভিযোগ করেন। ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের হৈ চৈ অসহ্য’ মন্তব্য করে তিনি রাখাইন রাজ্যে আইনীভাবে সন্ত্রাস দমন হচ্ছে মন্তব্য করেন। পশ্চিমাদের নাচের পুতুল নব্য স্বৈরাচার অং সান সুচির সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা বক্তব্য দিয়েছেন। এ যেন স্বৈরাচারকে সমর্থন করতে মহাস্বৈরাচারী ভাষা।
রোহিঙ্গা নিধন ইস্যুর সমাধানের বদলে উল্টো এ নিয়ে আগের সামরিক সরকারের সুরেই কথা বলায় এরইমধ্যে সু চির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বানে অনলাইসে স্বাক্ষর করেছেন লাখ লাখ মানুষ। কারো নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার এমন দাবি এর আগে শোনা যায়নি। সু চির জন্য এটি বড় লজ্জার। অথচ তিনি সিংগাপুরের টিভিতে হেসে হেসেই সাক্ষাৎকার দেন। ক্ষমতায় বসে সূচি মানবিকতার সব কিছুই যেন বিসর্জন দিয়েছেন। রাখাইন রাজ্যে রীতিমতো চলছে রোহিঙ্গা নিধন। মৃত্যুর মিছিল চলছে। পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষ। ধর্ষিত হচ্ছে নারী-শিশু। পুড়েছে প্রায় এক হাজার ঘরবাড়ি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অথবা মানবাধিকার সংগঠন কাউকেই মিয়ানমার সরকার সেখানে যেতে দিচ্ছে না। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকেও বাধা দেয়া হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাখাইনে গণহত্যা চলছে। চলছে ধর্ষণ, নির্যাতন। খোদ জাতিসংঘ বলছে, সেখানে সম্ভবত গণহত্যা চলছে। এই পরিস্থিতিতে সূচি সাফাই গেয়েছেন নির্যাতনের। দোষারোপ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। কী আশ্চর্য! এ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ না দিলে সুচি ১৯ বছরের বন্দী জীবন থেকে কোনোদিন মুক্তি পেতেন না। আর তিনি সেই সম্প্রদায়কে দোষারোপ করছেন?
‘জন্মই যেন মহাপাপ’ এর আবর্তে ঘুরপাক ঘাচ্ছে নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমরা। মৃত্যুর বিভীষিকায় তারা যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেবে? পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্য তথা আরববিশ্বের পেটের ভিতরে ভূঁইফোড়া হিসেবে ইসরাইল সৃষ্টি করে ইহুদিদের বসবাস নিশ্চিত করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না মিয়ানমার। অথচ তারা শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করছেন তারা। তাহলে সমাধান কি? সমাধান একটাই তা হলো রাখাইনকে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাষ্ট্র করা। এ জন্য দরকার আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ। চাপটা প্রথম দিতে হবে প্রতিবেশী ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের কাছ থেকে। এরপর ওআইসি ও জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সার্ক, আরব লীগ, আসিয়ানের মতো দেশ ও সংগঠনগুলো যদি একযোগে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তারা যদি বলে যে দ্রুত রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা থামাও। হয় ওদের নাগরিকত্ব দাও নয়তো আলাদা রাষ্ট্র দাও; নইলে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে, জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী পাঠানো হবে, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। তবেই কেবল রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হতে পারে। এর জন্য বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মুসলমানদের আন্দোলন করতে হবে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং বিশ্বময় আওয়াজ তুলতে হবে ‘রোহিঙ্গা মুসলমানরাও মানুষ; ওদের নাগরিকত্ব দিতে হবে’। পাশের দেশ হিসেবে কিছু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছেন, খাবার দিচ্ছেন; অথচ ওদের নাগরিকত্ব দেয়ার দাবিতে আওয়াজ তুলছি না। বিপন্ন মুসলিম এক জাতিগোষ্ঠীর জন্য মুসলিম সম্প্রদায় জেগে উঠবে না এটা কেমন কথা?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।