Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নতুন প্রকল্পের আশায় ইসি

বিরোধীদের অনাস্থা সত্ত্বেও ইভিএম এ নির্বাচন বিশাল টাকার প্রকল্প অনুমোদন হলে তাতে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হবে- বদিউল আলম মজুমদার : সরকারের ইচ্ছানুযায়ী কাজ কারর জন্য ইসিকে খুশি করতে

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিরোধী অনেক রাজনৈতিক দলের আপত্তি সত্ত্বেও ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে ইসি নিজেই ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। ইভিএমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ইসি নতুন প্রকল্প পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২ লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাব দেওয়া হবে। এ বিষয়ে নির্বাচন ভবনে আজ নির্বাচন কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ১০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পেলেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত ১৫০ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। জাতীয় নির্বাচন ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। তাই প্রকল্প দ্রুত পাস না হলে ১৫০ আসনে ইভিএমের ভোট করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আর থাকবে না নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটির হাতে।
ইসি ইতোমধ্যে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, এখন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত ইসির কী কী কার্যক্রম চলবে তা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে রোডম্যাপ প্রস্তুত করলেও ঠিক কতটি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে তা নির্ধারণ করতে পারেনি ইসি। ইসি কর্মকর্তারা ইভিএম নিয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রথমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা দিয়েছিলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এরপর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, যদি সচিবালয় যথাসময়ে ইভিএম দিতে পারে, তাহলে ১৫০টি আসনে এ পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হবে। আর যদি সচিবালয় সময়মতো দিতে না পারে তাহলে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে। সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। এছাড়া ইসির চূড়ান্ত রোডম্যাপেও ইভিএম সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ নেই।
তবুও ইসি ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ইসির রোডম্যাপে ইভিএম নিয়ে কিছু না থাকে, তাহলে তা অসম্পূর্ণ রোডম্যাপ। তাছাড়া দেশের বর্তমান আর্থিক সংকটের মধ্যে নতুন ইভিএম কেনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগ্রহণ খুবই দুঃখজনক। এ ছাড়া প্রকল্প মানেই দুর্নীতির মহোৎসব। এর আগে ইভিএম কেনায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় শুধু ইভিএম ক্রয়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার দুর্নীতি অভিযোগ আছে। এবারও এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন পেলে ব্যাপক দুর্নীতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, ইসির সঙ্গে সংলাপের সময় অধিকাংশ দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে তাদের মতামত দিয়েছে। তবুও ইসি ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বাড়বে। তাছাড়া ইভিএম নিয়ে নতুন করে বিশাল টাকার প্রকল্প অনুমোদন হলে তাতে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের বিদ্যমান আর্থিক সঙ্কটকালে এটা হবে খুবই দু:খজনক।
একেক বার একেক কথা বললেও ইসি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প শুরু করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় দুই লাখ ইভিএম মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতি ইউনিট ইভিএমের প্রাথমিক দাম প্রায় ২ হাজার ৪০০ ডলার অর্থাৎ ২ লাথ ৪০ হাজার টাকা করে পড়বে ইসি সচিবকে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পে ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ১৯টি জেলায় ওয়্যারহাউজ নির্মাণ ও মেশিন পরিবহনে পাঁচ শতাধিক গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু গত ৭ সেপ্টেম্বর ইসির এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর জানা যায়, এ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। চলতি মাসেই সরকারের অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ রাকিবুল হাসান ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে বলেন, ইভিএমগুলো সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি ওয়্যারহাউজ হবে ২১ হাজার বর্গফুটের। ওয়্যার হাইজগুলোর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রগুলো দেখভাল-পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পরিবহনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ খরচ হবে।
বিএনপি ইভিএমের বিষয়ে সব সময় আপত্তি জানিয়ে আসছে। তাদের মতে ইভিএম হচ্ছে ভোট কারচুপির মেশিন। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের আপত্তি সত্বেও ইসি সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইভিএমের ব্যাপারে সরকারের মহাজোটের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টি বেশ জোরালো আপত্তি করছে। তারাও বলছে এটি শান্তিপূর্ণ কারচুপির মেশিন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন দেশে বিশিষ্ট ৩৯ নাগরিক। ঐকমত্য ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে বলে দেশের এই বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব, যা জাতি হিসেবে আমাদের চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে। তাই জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য ইসির প্রতি তারা আহ্বান জানিয়েছেন ।
বিবৃতিতে বলা হয়, কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার একটি কারণ হলো, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে, তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি পুনর্গণনা বা নিরীক্ষার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান মরহুম জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। প্রসঙ্গত, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয় বলেও তারা উল্লেখ করেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ইনকিলাবকে বলেন, এই সরকার গণবিছিন্ন হয়ে পড়েছে। সরকার নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে স্বাভাবিক নির্বাচন চায় না। সরকারীদল ও তাদের কয়েকটি মিত্রদল ছাড়া আর সব দলই নির্বাচনে ইভিএম চায় না। কিন্তু সরকারের ইচ্ছাপূরণের জন্য নির্বাচন কমিশন ইভিএমে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ মেশিনে ভোট হলে নির্বাচন কমিশন যাকে ঘোষণা করবে সেই এমপি নির্বাচিত হবে। এর বিরুদ্ধে আপত্তি করার কোন সুযোগ থাকবে না। গত নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করে এ সরকার পার পেয়েছে। এবার তারা ইভিএমের কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছে। ইসি সরকারের এ ইচ্ছা পূরণে সহযোগী হিসাবে কাজ করছে। আর সরকারের ইচ্ছানুযায়ী কাজ কারর জন্য ইসিকে খুশি করতে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প শুধু নয় আরও বেশি সুযোগ সুবিধা দিতে প্রস্তুত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ