Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

৪১ বছরে নজিরবিহীন খরা

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৪ এএম

৫০০ বছরের মধ্যে উষ্ণতম বিশ্ব : দেশে ত্রিশ বছরে সর্বাপেক্ষা উত্তপ্ত আবহাওয়া
পানির অভাবে আমনসহ ফল-ফসলে বিপর্যয় : শীতকাল কেমন যাবে? হ উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উজানে ভারতে ভারী বর্ষণের আভাস
প্রতিবছর বর্ষায় দেশ খরা কবলিত হলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম
নজিরবিহীন খরতাপের কবলে পড়েছে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ^। বাংলাদেশে টানা ৩ মাসেরও বেশিদিন যাবৎ তীব্র খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। বৃষ্টিপাতে হচ্ছে মারাত্মক অনিয়ম-অসঙ্গতি। যা এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। ১৯৮১ সাল থেকে জলবায়ুর হিসাবে, গত ৪১ বছরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা খরা-অনাবৃষ্টির মধ্যদিয়ে চরম বৈরী আবহাওয়ায় অতিবাহিত হয়েছে গেল জুলাই-আগস্ট মাস। অর্থাৎ ভরা বর্ষা-বাদলের আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র মাসগুলো কেটেছে তীব্র খরা পরিস্থিতিতে। গত জুলাই মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় সার্বিকভাবে গড়ে ৫৭.৬ শতাংশ কম এবং আগস্ট মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। দুই মাস মিলে গড়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে প্রায় অর্ধেকই ঘাটতি হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের বিশ্লেষণ সূত্রে একথা জানা গেছে। গত ৫০০ বছরের মধ্যে বিশ^ উষ্ণতম বছর অতিক্রম করছে। বিশে^র বিশেষ করে ইউরোপ মহাদেশে প্রধান নদ-নদী, হ্রদগুলো অধিকাংশই শুকিয়ে গেছে। এতে করে পণ্যবাহী জাহাজ-নৌযান চলাচল, মাছ শিকারসহ নদীভিত্তিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। জাহাজে কম ওজনের পরিমান পণ্যসামগ্রী বহন করতে হচ্ছে। তাছাড়া ঘটছে পরিবেশ-প্রকৃতির নানামুখী বিপর্যয়। বাংলাদেশেও গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করছে। নদ-নদী, খাল, জলাশয়গুলোর পানি শুকিয়ে প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অসময়েই দেশজুড়ে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরতে নজিরবিহীন খরা-তাপদাহের পরিপ্রেক্ষিতে আসছে শীত মওসুম কেমন যাবে তা নিয়ে কৌতুহল-সংশয় রয়েছে। বাতাসে জলীয়বাষ্প বা আর্দ্রতার হারে কম-বেশি তারতম্য এবং ঊর্ধ্বাকাশের জেটবায়ুর নিম্নমুখী কম বা বেশি হলে শীতের প্রকোপও কম-বেশি হয়। এবারে শীতের তীব্রতা কম নাকি বেশি হবে তা সময়ই বলে দেবে।

বিরাজমান খরা-অনাবৃষ্টির নজিরবিহীন বৈরী আবহাওয়া প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, শুধুই বাংলাদেশেই নয় চীন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত এবং ইউরোপে তীব্র খরা-অনাবৃষ্টি ও তাপদাহে পুড়ছে। অন্যদিকে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে তিনগুণ বেশি বৃষ্টিপাতের ফলে পাকিস্তানের তিন ভাগের একভাগ অঞ্চল মারাত্মক বন্যায় ভাসছে। তিনি বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় ন্যুনতম পরিমানে বৃষ্টিপাত হয়নি। এতে করে পানির অভাবে কৃষকেরা অনেক জায়গায় রোপা আমন ধান আবাদ করতে পারেননি। তারা পাট জাগ দেয়ার মতো পানিও এবার অনেক এলাকায় পাননি। এ বছরের মতো প্রতি বছর বছর যদি দেশ বর্ষা মৌসুমেই খরা-অনাবৃষ্টির কবলে পড়ে তাহলে দেশের কৃষি অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আবহমান বাংলাদেশে বর্ষাকালের ব্যাপ্তি হারিয়ে যেতে বসেছে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ভরা বর্ষণের জের থাকে ভাদ্র তথা আগস্ট মাসেও। অথচ গেল আগস্টে অর্থাৎ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের ভরায় সারা দেশে সার্বিকভাবে গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা গত ৪১ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা কম বৃষ্টিপাত তথা অকালে খরার রেকর্ড। ১৯৮১ সাল থেকে আগস্ট মাসে আবহাওয়া বিভাগের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৮৯ সালে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫৩ শতাংশ কম, ২০২০ সালে ৩৯ শতাংশ কম, ১৯৯০ সালে ৩৬ শতাংশ কম এবং ২০০১ সালে ৩৫ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়। গেল আগস্ট মাসে সারা দেশে বৃষ্টিপাত হয়েছে গড়ে ২৪৭ মিলিমিটার। আগস্টে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ৪০২ মি.মি.। গত জুলাই মাসে সারা দেশে বৃষ্টি ঝরেছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার। মওসুমের এ সময়ে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৯৬ মি.মি.। গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত বা খরতপ্ত আগস্ট মাস অতিবাহিত হয়েছে এবার বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপী। গেল ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের প্রায় সর্বত্র মাসজুড়ে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে।

দেশে ভরা বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক খরা-অনাবৃষ্টি কবলিত হয়েছে। এর ফলে রোপা আমন ধানসহ বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল ফল-ফসল, ক্ষেত-খামারে চাষাবাদ ও উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। খরা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় কৃষকের চোখেমুখে অন্ধকার। কেননা বৃষ্টি-নির্ভর আমন ফসল ও অন্যান্য ফল-ফসলের আবাদ সেচের পানি দিয়ে পূরণ করার আর্থিক সামর্থ্য নেই বেশিরভাগ কৃষকের। তদুপরি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা কৃষক। অনেক জায়গায় সেচপাম্প বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমন ফসল উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি-নির্ভর অন্যান্য ফল-ফসলও টানা খরার কবলে পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া খরা-অনাবৃষ্টিতে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রকৃতি, জীবনধারণ, উৎপাদনশীলতায় বিরূপ পড়ছে। ঘরে ঘরে মানুষ জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। দেখা দিয়েছে জনস্বাস্থ্য সঙ্কট।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে বর্ষাকাল জুড়ে খরা-অনাবৃষ্টি এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতি হচ্ছে। আবহাওয়া-জলবায়ুর অস্বাভাবিক মতিগতি, বিরূপ বা বৈরী আচরণ এবং চরম-ভাবাপন্নতা দেখা যাচ্ছে।

উত্তর, উত্তর-পূর্বে নদ-নদী পরিস্থিতি ও বৃষ্টিপাত: পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভ‚ঁইয়া দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদ-নদী পরিস্থিতি ও বৃষ্টিপাত সম্পর্কে গতকাল জানান, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর কাছাকাছি ভারতের কতিপয় স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে এ সময়ে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যাদুকাটা, সোমেশ^রী, সারিগোয়াইন ও ভুগাই-কংস নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানির সমতল ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। পূর্বাভাস কেন্দ্র আরও জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

গতকাল ২৪ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে- লাটুতে (সিলেট) ১৫০ মিলিমিটার, লরেরগড়ে (সুনামগঞ্জ) ১২০ মি.মি., দুর্গাপুর (নেত্রকোণা) ও জকিগঞ্জে (সিলেট) ৭৮ মি.মি.। অন্যদিকে উজানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গ্যাংটকে (সিকিম) ৫৮ মি.মি. এবং শিলচরে (আসাম) ৫৩ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে।
পাউবো’র ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৭৫টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩১টিতে হ্রাস পায়। ৩টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত থাকে। আগের দিন বুধবার ৭৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩২টিতে হ্রাস ও ৪টিতে অপরিবর্তিত থাকে।

সেপ্টেম্বরেও থাকবে খরা-অনাবৃষ্টি: চলতি সেপ্টেম্বরে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও স্বাভাবিকের তুলনায় সারা দেশে সার্বিকভাবে কম বৃষ্টিপাত তথা খরার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৃদু তাপপ্রবাহ (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বয়ে যেতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার আবহাওয়া অধিদফতর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় দীর্ঘমেয়াদি এ পূর্বাভাস দেয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান।

গেল আগস্ট মাসে (শ্রাবণ-ভাদ্র) দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৩৬.৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় বলা হয়, গেল মাসে সারা দেশে এলাকাওয়ারি বৃষ্টিপাতে ছিল অসঙ্গতি। গত মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে কম, স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৪.৫, ঢাকায় ৩৬.৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আগস্ট মাসে বঙ্গোপসাগরে চারটি লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ সক্রিয় না হয়ে দুর্বল হয়ে স্থলভাগের দিকে সরে যায়। বৃষ্টিপাত কম হওয়ার এটি অন্যতম কারণ। গত আগস্ট মাসে দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ২.১ এবং সর্বনিম্ন ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে ২টি লঘুচাপ সৃষ্টি এবং এরমধ্যে একটি বৃষ্টিবাহী নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খরা

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
২ সেপ্টেম্বর, ২০২২
৩ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ